রাজনীতি

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ বাড়ছে,ফায়দা লুটা ১’শ এমপি চিহ্নিত

  এস এম রাফি ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ , ৮:১২ পূর্বাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ

সদরুল আইনঃ

আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ বাড়ছে, পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করার দাবি উঠলেও তৃণমূল নেতৃত্বের ফায়দা লুটে আখের গোছানোর কারনে তা আলোর মুখ দেখছে না।

বিরোধী মতাদর্শী, বর্ণচোরা অনুপ্রবেশকারীরা তৃণমূল আওয়ামী লীগের জন্য শঙ্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে।পদকে কাজে লাগিয়ে বিপুল অর্থ লুটে নেওয়া ১’শ এমপির খতিয়ান এখন প্রধানমন্ত্রীর টেবিলে।এদেরকে মনোনয়ন বঞ্চিত করার ঘোষণা দেওয়ার পরও থামছে না তাদের অনৈতিক কর্মযজ্ঞ।

কৌশলে দায়িত্বপ্রাপ্ত একশ্রেণির নেতাদের ম্যানেজ করে ইতিমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিও বাগিয়ে নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। তাদের দাপট আগের চেয়ে আরও বেড়েছে।
অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতায় তারা পরিপুষ্ট।

অনুপ্রবেশকারীদের ভিড়ে অনেকটা কোণঠাসা ত্যাগী নেতাকর্মীরা। কৌশলে প্রভাবশালী হয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন তারা।এ কারনে দলের মূল নির্যাস থেকে রাজনীতি করা অনেক পরিবার এখন রাজনীতিবিমুখ।

অথচ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বলে আসছেন, ‘বিভিন্ন সংকটে দলের বড় নেতারা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলেও তৃণমূল সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তৃণমূলই দলের প্রাণ, মূল চালিকা শক্তি।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য কর্ণকুহরে ঢুকছে না জেলা উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত শীর্ষ নেতাদের।

নিজেদের পদ পদবিতে চিড় ধরার ভয়ে এবং আ.লীগের মূল স্রোতে থাকা পরিবারগুলো থেকে শীর্ষ পদ বা নেতৃত্বে নিয়ে আসতে অনেক এমপি’র মধ্যে রয়েছে অনীহা।এর একটাই কারন, তাদের দিয়ে ব্যবসায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

এসব তৃণমূল আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের টার্গেট করছে স্বাধীনতা ও আওয়ামীবিরোধী চিন্তাধারার ব্যক্তিরা। তারা দলে ভিড়ে ত্যাগী নেতাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার পর্যন্ত করছে।

তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যারা নিবেদিতপ্রাণ বলে পরিচিত ছিলেন, দলের দুর্দিনে যারা ত্যাগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, আজ তারাই নিপতিত হয়েছেন চরম দুর্দিনে।

ক্ষমতাবান, সুবিধাভোগী আর স্বার্থবাজ নেতারা তাদের দূরে ঠেলে রেখেছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডেও অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। প্রভাবশালী নেতাদের চারপাশে এখন সুযোগসন্ধানী অনুপ্রবেশকারী নেতাদেরই ভিড়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা ১৪ বছর সরকার পরিচালিত হচ্ছে। বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলেও স্বাধীনতাবিরোধী ও ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা হাত গুটিয়ে বসে নেই।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত আওয়ামী লীগে যোগদান করছেন।

ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, অনুপ্রবেশকারীরা খুবই সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করে তৃণমূল পর্যায়ে যেমন ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা কমিটি গঠনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সন্তুষ্ট করে কমিটির গুরুত্বহীন পদ-পদবি ম্যানেজ করে আওয়ামী লীগার সেজেছেন।

সুবিধাজনক সময়ের খুবই ধীর গতিতে এগোতে থাকেন তারা । ঐ নেতাদের ছবির সঙ্গে নিজের ছবি সংযুক্ত করে ফেস্টুন-ব্যানার লাগিয়ে আত্মপ্রচার শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে আরও ওপরের পর্যায়ের নেতাদের ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে ভূরিভোজ করিয়ে ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে সন্তুষ্ট করেন।

পরে স্থানীয় থানা বা জেলা পর্যায়ের নেতাদের অবগত না করে, তাদের অনুমতি ছাড়াই ঐ সব কেন্দ্রীয় বড় বড় নেতাদের অতিথি করে ব্যক্তিগত প্রচারের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা বড় নেতাদের সম্মানে ঐ সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে অনুপ্রবেশকারীদের আত্মপ্রচারকে বৈধতা দিতে বাধ্য হন।

এমনিভাবে সুযোগসন্ধানী বর্ণচোরা নব্য আওয়ামী লীগাররা সংগঠনে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের নির্দেশনার পরেও মূল্যায়ন হচ্ছে না তৃণমূলের ত্যাগী নেতাদের। শুধু তা-ই নয়, অনুপ্রবেশকারীদের রোষানলেও পড়তে হচ্ছে আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের।

দলের দুঃসময়ে যারা এগিয়ে আসেন, তাদের কেন মূল্যায়ন হয় না—এখন এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে। গত ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচিতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ও ১৫ আগস্টের খুনিদের দোসররা এখনো ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে।’

সম্প্রতি একাধিক দলের ঘরোয়া বৈঠকেও তিনি একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তার পরও অনুপ্রবেশকারীদের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।

অথচ এই অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ত্যাগীরা বঞ্চিত-নিপীড়িত; তাদের মুখে শুধুই হতাশার সুর। বিভিন্ন কমিটিতে এক শ্রেণির নেতারা দুর্নীতি-অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ; তাই দেখে নিবেদিতপ্রাণ নেতারা প্রতিবাদ করতে গিয়ে হচ্ছেন নির্যাতিত। তাদের অনেকে ক্ষোভে-দুঃখে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। এই অবস্থা আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোতেও।

অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি ঘরানার এক শিল্পপতির দুই ছেলে (বয়স ১৯ ও ২১ বছর) মহানগর আওয়ামী লীগের দুই থানা (শ্যামপুর ও কদমতলী) কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

গত ১৭ এপ্রিল ২০২২ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত আলোচনাসভায় মুজিবনগর সরকারের অন্যান্য নেতার পাশাপাশি খুনি খন্দকার মোশতাকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক শীর্ষ নেতা।

তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন নীল দল থেকে নির্বাচিত। এ নিয়ে ব্যাপক সামালোচনা শুরু হলে এ ঘটনার জন্য তিনি ক্ষমা চান এবং বিষয়টি ‘অনিচ্ছাকৃত’ বলে উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশ থেকে যারা বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনে বাধা দিয়েছে, তাদের আওয়ামী লীগে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আওয়ামী লীগের পদ-পদবি পেতে অর্থ বিনিয়োগকারী এবং অর্থ বিনিয়োগে সহায়তাকারী নেতাদেরও চিহ্নিত করা প্রয়োজন।

অনতিবিলম্বে যদি আওয়ামী লীগের এই অনুপ্রবেশকারীদের দাপট ঠেকানো না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত তৈরি হবে।

রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত শান্তি কমিটির প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এমন ব্যক্তি ও তাদের সন্তান-স্বজনদের কেউ কেউ নানা কৌশলে ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে ঢুকে পড়েছেন।

তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে ত্যাগের মূল্যায়ন পাচ্ছেন না দুর্দিনের নেতারা। অন্যদিকে দলে অনুপ্রবেশকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। সারা দেশে দলের একটি বড় অংশ বঞ্চিত। দলের একশ্রেণির প্রভাবশালী নেতাদের ব্যক্তিগত বলয়ের কারণে তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করার জন্য একাধিক বার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ত্যাগীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে—এমন শত শত অভিযোগ জমা পড়েছে ধানমন্ডিস্থ দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে।

আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রে আছি। আমরা চেষ্টা করি ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে। কেন্দ্র মূল্যায়ন করবে মহানগর ও জেলা কমিটিকে। জেলা মূল্যায়ন করবে উপজেলাকে। উপজেলা মূল্যায়ন করবে ইউনিয়নকে। ইউনিয়ন মূল্যায়ন করবে ওয়ার্ডকে।

এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা কী হয়? আমরা কী আসলেই ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতে পারছি?’

এক শেখ হাসিনা যতই ত্যাগীদে মূল্যায়ণের কথা বলুন না কেন,তৃণমূল সে কথার তোয়াক্কা করে না।বিশেষ করে এমপিরা নিজেদের বলয় তৈরি করতে,ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে নিজেদের আস্থাভাজনদের দিয়ে কমিটি করে ত্যাগীদের অবমূল্যায়ণ করায় দল ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

এছাড়া এমপি লীগ,পছন্দ লীগ,তল্পিবাহক দিয়ে কমিটি করে তারা ব্যবসায়িক সার্কেল গড়ে তোলে।বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক বনে যায়।দেশে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ে।পরিবারের সদস্যদেরকে ব্যবসায়িক বৃত্তে সম্পৃক্ত করে অনৈতিক পথে আখের গোছাতে ব্যাপৃত হয়।এতে দল ক্ষতিগ্রস্থ হয়।নেতা কর্মিদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।সুবিধা বঞ্চিত হয় দূর্দিনের ত্যাগীরা।

সততার মুখোশ পরে থাকা অনেক নেতাই রাজনীতি করেন আখের গোছানোর জন্য।নীতি আদর্শের কথা মুখে বলে জনগনের সাথে প্রতারণা করে ক্ষমতায় এসে রাজনীতিকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিনত করে।এসব কারনেই দল জনপ্রিয়তা ও জনআস্থা হারিয়ে গভীর সংকটে নিপতিত হয়।