এস এম রাফি ৫ অক্টোবর ২০২৩ , ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ আজ।
স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কাজ শুরু করতে চেয়েছিলেন। কথা শুরু করেছিলেন ফরাসি ও রাশানদের সঙ্গে। অবশেষে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সফল হলো বাংলাদেশ।
ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের জন্য রাশিয়া থেকে এসেছে ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম।
আজ বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর অনুষ্ঠান (গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান) হবে। দুপুরে এই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
ঐতিহাসিক এই গ্র্যাজুয়েশনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের ৩৩তম ইউরেনিয়াম জ্বালানির যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। আমরা এখন নিউক্লিয়ার ক্লাবের গর্বিত সদস্য।
১৯৬২ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার প্রমত্তা পদ্মা নদী তীরবর্তী রূপপুরকে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানকে ঘিরে উৎসবের সাজে সেজেছে রূপপুর। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিভিন্ন রঙের পতাকা শোভা পাচ্ছে। গ্রিনসিটি আবাসিকের সামনের প্রাচীরে রঙিন চিত্রকর্ম নজর কাড়ছে সবার।
একদিকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অন্যদিকে সাজসাজ রব। সব মিলিয়ে রূপপুর যেন স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ভিন্ন এক জায়গা। তবে ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে এখানকার মানুষ উন্মুখ হয়ে আছেন বলে জানিয়েছেন।
ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে রূপপুরে এসেছে উচ্চপর্যায়ের রুশ প্রতিনিধিদল। প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছেন মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বুধবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান কবিতার ভাষায় বলেন, ‘পিতা চেয়েছিল পরমাণু যুগ শুরু হোক রূপপুরে, পিতার চাওয়া হয়েছে পূরণ কন্যার হাত ধরে। রূপপুর আজ রূপ পেয়েছে অর্জন অশেষ; এই না হলে শেখের বেটি সাবাস, সাবাস বাংলাদেশ।’
এ সময় দেশের জিডিপিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২ শতাংশ অবদান রাখবে বলে জানান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান।
এদিকে গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানের পর আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর।
তিনি বলেন, মাসটিতে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাবে রূপপুরে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট। তবে ২০২৫ সালের শুরুতেই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি উৎপাদনে গেলে প্রতিদিন জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কমবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও।
শুক্রবার রাশিয়া থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান রূপপুর পৌঁছে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্পটিতে ৭ হাজার পেশাদারসহ ৩০ হাজার দেশি-বিদেশি কর্মী কাজ করছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে পারমাণবিক ক্লাবে প্রবেশ বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
কারণ, এটি কার্বন নিঃসারণ হ্রাস লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। একই সময়ে এটি ফ্ল্যাশের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়ে দেবে।
এদিকে প্রকল্প পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, আরএনপিপি প্রতিদিন ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কার্বন নিঃসারণ কমানোর বৈশ্বিক উদ্যোগ নিশ্চিত করবে।
রাশিয়ান ঠিকাদার হিসেবে রোসাটম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট নিয়ে গঠিত। মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরমাণু শক্তি কমিশন আরএনপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
রাশিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি অ্যাটমস্টোএক্সপোর্ট প্রকল্পের অধীনে ১২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে। পারমাণবিক জ্বালানি রোসাটমের সহযোগী কোম্পানি টিভিইএল ফুয়েল তৈরি করছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানি ক্রয় করে।
২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ এগিয়ে নেয়।
২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ১ হাজার ৬২ একর জমির ওপর প্রকল্পের পূর্ণোদ্দমে কাজ শুরু হয়। সূত্র আরও জানায়, ২০২১ সালের অক্টোবরে, ইউনিটের কাঠামোর মধ্যে চুল্লি স্থাপনের মাধ্যমে রূপপুর ইউনিট-১ প্রায় সম্পন্ন হয়।
এটি এআইইএ-এর মান অনুযায়ী স্থাপন করা হয়। চুল্লি একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান উপাদান। গত বছরের অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লি স্থাপন করা হয়।
জানা গেছে, প্রথম ইউনিট (১২০০ মেগাওয়াট) চালু করার জন্য ৭৫ টন ইউরেনিয়াম প্রয়োজন হবে। একবার জ্বালানি দেওয়ার পর ১৮ মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এরপর এক-তৃতীয়াংশ ইউরেনিয়াম অর্থাৎ ২৫ টন তুলে সেখানে নতুন রড দিতে হবে। এরপর আবার ১৮ মাস চলবে। এভাবে ১৮ মাস পরপর আংশিক জ্বালানি পরিবর্তন করতে হবে।
এক কেজি ইউরেনিয়াম প্রায় ১০০ টন কয়লার সমান তাপ উৎপাদনে সক্ষম। আর একই পরিমাণ তাপ তেলে উৎপাদন করতে হলে ৬০ টন ডিজেল প্রয়োজন হবে। যে কারণে সহজে পরিবহনযোগ্য বিবেচনা করা হয়। এই জ্বালানি একবার লোড করে নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৮ মাস বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ অন্য জ্বালানিতে পেতে হলে অনবরত সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেডিয়েশন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। রেডিয়েশনের মাত্রা মানুষের সহন ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। আমরা ২৩টি রেডিয়েশন স্টেশন চালু করব, সেখানে রেডিয়েশনের মাত্রা প্রদর্শিত হবে। যে কেউ দেখতে পারবেন।
এসব স্টেশন ১৮ কিমি দূরে পর্যন্ত থাকবে। আমরা দেখেছি ১২.৫ কিলোমিটার দূরে মনিটরিংয়ের প্রয়োজন নেই। যেভাবে বসবাস করছে সেইভাবে করতে পারবে।