হারুন উর রশিদ সোহেল,রংপুর ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ৭:৫১ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
রংপুর মহানগরীসহ জেলার সবজি বাজার সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। শীতকালীন বিভিন্ন সবজির দ্বিগুণ দামে ক্রেতারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গত মৌসুমে দাম ক্রেতারা সাধ্যের মধ্যে থাকলেও এবারে দাম বৃদ্ধির কারণে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক ক্রেতাসহ সাধারণ মানুষজন। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, এবারে উৎপাদনে খরচ বেশি ও সিন্ডিকেট এই দুই কারণে সবজির দাম চড়া।
এদিকে বাজারে চড়া দামে সবজি বিক্রি হলেও রংপুরের সবজি চাষিরা ‘পাইকার’ নামের সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।
জানগেছে, মিঠাপুকুর উপজেলা হচ্ছে রংপুর অঞ্চলের সবজি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এর পরেই পীরগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলায় বেশি সবজি চাষাবাদ হয়। এছাড়াও রংপুর সদরের সদ্যপুষ্করনী ইউনিয়ন সবজির জন্য বিখ্যাত। এই এলাকাগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সবজি উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় এবং স্থানীয় বাজার ব্যবস্থার অভাবে ন্যায্য ম্ল্যু থেকে বঞ্চিত থাকেন বেশিরভাগ চাষিরা।
মিঠাপুকুর উপজেলার রানীপুকুর, জায়গীরহাট, লতিপবপুর, শুকুরেরহাট, ময়েনপুর, কাফ্রিখাল, আলিপুর, বালারহাট, রংপুর সদরের পালিচড়া, জানকি ধাপেরহাট, শ্যামপুর ও গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর, এসকেএস বাজার, লক্ষিটারি, গজঘন্টাসহ বিভিন্ন বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, এসব এলাকার ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, সীম, গাজর, করলা, মুলা, বেগুন, সহ রকমারি শীতকালীন সবজি চাষাবাদ হচ্ছে। মাঠে সবজি ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটছে কৃষক-কৃষাণীদের। কেউ ক্ষেত থেকে ফসল তুলছেন, কেউ বা পরিচর্চা অথবার স্প্রে করছেন সবজি ক্ষেতে। কারোও দম ফেলার সময় নেই।
এসব উৎপাদিত সবজি প্রতিদিন ট্রাকযোগে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকার প্রধান কাঁচামালের আড়ত কারওয়ান বাজারসহ খুলনা, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। পাইকার নামক এক শ্রেণীর লোক নানা অজুহাতসহ সিন্ডিকেট করে চাষি বা বিক্রেতার নিকট থেকে কম দামে শাক-সবজি ক্রয় করছেন। শুধুমাত্র হাত বদল করেই লাভ করছেন স্থানীয় পাইকাররা। অথচ বাজার থেকে ভোক্তাদের সেই সবজি কিনতে হচ্ছে দ্বিগুণ দাম দিয়ে। এর ফলে কারসাজিতে শাকসবজি চাষ করেও আশানুরুপ দাম না পাচ্ছেন না চাষিরা। এনিয়ে চাষিরা চরম ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও করার কিছু নেই তাদের।
কৃষকরা জানান, চাষাবাদ করা শাকসবজি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই সিন্ডিকেটের কারণে কমদামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। আগাম সবজি উত্তোলনের পর ওই জমিতে দ্বিতীয় দফায় শীতকালীন সবজি চাষ করা যায়। তবে ভরা মৌসুমে খুব একটা দাম পাওয়া যায় না। উৎপাদন খরচই ওঠে না অনেক সময়। আর ন্যার্য্য মুল্য বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
এদিকে কৃষক পর্যায়ে মুলা ২-৩ টাকা, পাইকারি ৫-৭ টাকা, ভোক্তা পর্যায়ে ২০ টাকা, পাতা কপি কৃষক পর্যায়ে ১০ টাকা, পাইকারি ১৫ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ২০ টাকা, ফুলকপি কৃষক পর্যায়ে ২০ টাকা, পাইকারি ৩০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৪০ টাকা, কাঁচা পিয়াজ কৃষক পর্যায়ে ৫০ টাকা, পাইকারি ৬০-৬৫ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। কাঁচা মরিচ কৃষক পর্যায়ে ৪০ টাকা পাইকারি ৫০ টাকা, ভোক্তা পর্যায়ে ৬০ টাকা, ঢোপা বেগুন কৃষক পর্যায়ে ৪৫ টাকা, পাইকারি ৬০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৮০ টাকা, চিকন বেগুন কৃষক পর্যায়ে ৪০-৪৫ টাকা, পাইকারি ৫৫-৬০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, টমেটো কৃষক পর্যায়ে ২০ টাকা পাইকারি ৩০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, গাজর কৃষক পর্যায়ে ১৫ টাকা, পাইকারি ২০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৩০ টাকা, শিম কৃষক পর্যায়ে ২৫ টাকা পাইকারি ৩৫-৪০ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রংপুর সিটি বাজার, কামাল কাছনা, লালবাগ, মর্ডাণ মোড়, মাহিগঞ্জ ও সাতমাথা, টার্মিনাল বাজারসহ মিঠাপুকুর ও গঙ্গাচড়া উপজেলার বিভিন্ন বাজার এলাকায় ঘুরে এমন তথ্য জানাগেছে।
মিঠাপুকুরের লতিবপুর বউবাজার এলাকার মজনু মন্ডল নামের এক চাষি জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে বেগুন, ফুলকপি ও বাধাকপির চাষ করেছেন। জমি তৈরিসহ বীজ, সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য খরচ হয়েছে বিঘাপ্রতি প্রায় ২৫ হাজার টাকার বেশি। যে দামে বিক্রি করি তাতে লাভ তেমন হয় না।
আমিনুল ইসলাম ও হুমায়ন রশিদ শাহীন নামের দুই ক্রেতার সাথে কথা হয় রংপুর সিটি বাজারে। তারা জানান, শীতের মৌসুমে গতবার সবজির দাম কম ছিল। এবার তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কৃষকের কাছ থেকে কমদামে কিনে আনলেও তা চড়া দামে বিক্রি করছেন চাষিরা।
এব্যাপারে রংপুর কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ পরিচালক (শস্য) আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে জানিয়েছেন, রংপুর মহানগরীসহ জেলার আট উপজেলায় শাকসবজির আবাদ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। যা এখন বাজারে উঠতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, সবজি মানেই পচনশীল পণ্য। সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় ক্ষেত থেকে উত্তোলন করেই বিক্রি করতে হয় কৃষকদের। এজন্য সমস্যাও হয়। বিষয়টি কৃর্তপক্ষকে অবহিত করা হবে বলেও তিনি জানান। ##
লাভের আশায় অপরিপক্ক আলু তুলছেন রংপুরের
চাষিরা, হিমাগারে পর্যাপ্ত সংরক্ষণ নিয়ে সংশয়
# লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাষ
# ফলনও বাম্পার হয়েছে
# দাম বাড়ার আশঙ্কা
হারুন উর রশিদ সোহেল,রংপুর\
রংপুর মহানগরীসহ এ অঞ্চলের ৫ জেলার বিভিন্ন স্থানে লাভের আশায় সময়ের আগেই অপরিপক্ক আলু তুলছেন চাষিরা। তারা বেশি লাভের আশায় মৌসুম শেষের আগেই এ আলু ক্ষেত থেকে তুলছেন এবং সেই আলু ক্ষেতেই বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে বিভিন্ন স্থানে চাষিরা আলু তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
তবে অপরিপক্ক আলু তোলার কারণে চলতি মৌসুমে হিমাগারে পর্যাপ্ত আলু সংরক্ষণ নিয়ে সংশয় দেখছেন হিমাগার কর্তৃপক্ষ। আর হিমাগারে আলু না রাখলে আলুর দাম আগামীতে আরও বাড়বে বলে তারা মনে করেন।
কৃষি বিভাগ বলছে, রংপুর মহানগরীসহ জেলার আট উপজেলা ও রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলার বিভিন্ন স্থানে লাভের আশায় আলু চাষিরা অপরিপক্ক আলু তুলছেন। তবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানাগেছে, রংপুর মহানগরীসহ জেলার আট উপজেলা ও রংপুর অঞ্চলের নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং রংপুর জেলায় চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৬০২ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ করা হয়েছে। এ বছর রংপুর অঞ্চলে ৯৮ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সে হিসাবে ২ হাজার ৯২ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ বেড়েছে। এ বছর রংপুর জেলায় ৫৩ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে, যা রংপুর অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছর রংপুর অঞ্চলে ৯৭ হাজার ৩২৭ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ করা হয়েছিল। ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত আলু তোলা হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমির।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতর রংপুরের উপ-পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দিন জানিয়েছেন, রংপুরসহ সারাদেশে দেশি ও উচ্চফলনশীল দুই জাতের আলুই চাষ করা হয়। বর্তমান বাংলাদেশে হেক্টর প্রতি আলুর গড় ফলন ১১ টন। আলুর উৎপাদন হেক্টর প্রতি ২০ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। তবে চলতি মৌসুমে রংপুর অঞ্চলে বাম্পার ফলন হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে লাভের আশায় আলু চাষিরা অপরিপক্ক আলু তুলছেন। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে চাষিদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এদিকে আলু উৎপাদনে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চাষ হয়েছে রংপুর অঞ্চলে। এবার আলুর বাম্পার ফলনও হয়েছে। এতে চাষিরা খুবই খুশি। তবে মাঝে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ আর ঘন কুয়াশায় লেট বøাইটের শঙ্কা দেখা দিলেও এখন পর্যন্ত কোথাও তেমন ক্ষতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তারপরও চাষিরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, আলুর বর্তমান বাজার অনুযায়ী আলু তোলার খরচসহ প্রতি বিঘায় ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা লাগবে। তাতে লোকসান হবে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে আলু চাষি এই পরিমাণ জমিতে লাভ করেছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। তাই লাভের আশায় চাষিরা অপরিপক্ক আলু তুলছেন এবং বিক্রি করছেন।
রংপুর নগরীর খোর্দ্দ তামপাটের চাষি সিরাজুল ইসলাম শিকদার বলেন, এবার ৩বিঘা জমিতে আলুর চাষ করেছি। তার মধ্যে দুই বিঘার আলু তুল বিক্রি করছি। গত বছর আলু ক্ষেত থেকে ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করেছি। পরবর্তীতে ৫০ টাকা কেজি দরে কিনে খেতে হয়েছে। সেই তুলনায় এবারে আলুর ক্ষেতেই ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা যাচ্ছে। তবে লোকসানের সম্ভাবনা নেই বলেই তিনি জানান। বরং লাভ হচ্ছে।
সদরের জানকী রামজীবন এলাকার মনজুরুল ইসলাম বলেন, আলুর দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে, তবে গত বারের তুলনায় এবারে খরচও বাড়ছে। আলু তোলার শ্রমিকরা এবারে বেশি টাকা নিচ্ছেন। তারপরও লাভ হবে বলে তিনি জানান। তার মতো নগরীর তামপাট, সদরের পালিচড়া, শ্যামপুর ও নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের কয়েকজন চাষি একই কথা জানান।