রাবি প্রতিনিধি: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২:০২ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুজন সেনের বিরুদ্ধে বিভাগে অনিয়ম, অযোগ্যতা ও স্বেচ্ছাচারিতা এবং আবাসিক হলে প্রাধ্যক্ষ ও প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক থাকাকালীন ব্যাপক দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এই দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর প্রমাণসহ প্রায় ২০০ পৃষ্ঠার একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন তারা।
এর আগে, চারুকলা প্রাঙ্গণে ড. সুজন সেনের কুশপুত্তলিকা দাহ করে শিক্ষার্থীরা।
এসময় শিক্ষার্থীরা ‘ভাউচার সুজনের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’, ‘এক দফা এক দাবি, সুজন সেনের চাকরিচ্যুতি’, ‘চারুকলায় তেলবাজি, চলবে না, চলবে না’’, ‘চারুকলায় দূর্নীতি, চলবে না, চলবে না’, সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এরপরে উপাচার্য বরাবর দেওয়া অভিযোগের অনুলিপি বিভাগের সভাপতি বরাবর জমা দেন তারা। এছাড়া অনুলিপিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টার হাতেও তুলে দেন শিক্ষার্থীরা। এসময় ছাত্র উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনী সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন।
লিখিত অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘শিক্ষক হিসেবে ড. সুজন সেনের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষাদান করা। তবে এর পরিবর্তে তিনি স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। চারুকলার প্রতিটি বিষয় ব্যবহারিক সম্পর্কিত হওয়া সত্ত্বেও, কোনো শিক্ষার্থী তাকে সরাসরি শ্রেণির ব্যবহারিক বিষয় হাতেনাতে শিখিয়ে দিতে দেখেননি। শিক্ষার্থীদের মনমতো নম্বর প্রদান, খেয়াল খুশিমতো বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষা নেওয়া, অনেকক্ষেত্রে কোর্স শেষ না করেই পরীক্ষা নেওয়া, পছন্দের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা, শিক্ষার্থীদেরকে নানাভাবে অপদস্ত করা হয়। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফিল্ড স্টাডিতে গিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। এছাড়াও অন্যের কাজ চুরি করে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভাগে শিক্ষক হওয়ার কথাও উল্লেখ করেন শিক্ষার্থীরা।
অভিযোগপত্রে জানানো হয়, শহীদ জিয়াউর রহমান হলে প্রাধ্যক্ষ পদে থাকাকালীন সুজন সেন নাস্তা, খাবার, ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদি, তৈজসপত্রসহ অন্যান্য দ্রব্যাদি ক্রয়ের শতকরা ৮০ ভাগ ভাউচারেই জালিয়াতি করেছে। এই ভাউচারগুলোর মধ্যে কিছু ভাউচার তিনি নিজে লিখেছেন, কিছু ভাউচার হলসুপার মামুনুর রহমানকে দিয়ে লিখিয়েছেন। শুধুমাত্র মামুনুর রহমানের হাতে লেখা তিনশতাধিক জাল ভাউচারেই তিনি প্রায় ১০ লক্ষ ৪৬ হাজার ৪৫৬ টাকার দ্রব্যাদি ক্রয় দেখিয়েছেন।
তার তিন বছরের মেয়াদকালে তিনি, ৪ হাজার ২০০ টাকায় দুটি টিস্যু বক্স ক্রয় করে একটি নিজের বাসায় নিয়ে যায়। নাস্তা ও খাবার বাবদ প্রায় ৪ লক্ষ ১৮ হাজার ৮৯০ টাকা, ইন্টারনেট, লাইব্রেরী এবং ক্রীড়া তহবিল থেকে তিনি প্রায় ১ লক্ষ ৮২ হাজার ৬১০ টাকা, নিজের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাভন মেটালিক’ থেকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হলের জন্য তিনি প্রায় ২ লক্ষ ২০ হাজার ৫৪৫ টাকার নেমপ্লেট, অনারবোর্ড এবং ক্রেস্ট ক্রয়, প্রাধ্যক্ষের কক্ষ সম্প্রসারণের জন্য ১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে দুটি এসি এবং ইন্টোরিয়রের জন্য আসবাব, র্যাক, জানালার পর্দা, গ্লাস ভোর পর্দা, টিস্যু বক্স বাবদ ১ লক্ষ ৪০ হাজার ৭৩৩ টাকা ব্যয় করেন বলে জানা যায় অভিযোগপত্রে।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়,ছাত্র কল্যাণ তহবিলের ৫৩ হাজার ৫০০ টাকার পুরোটাতে প্রায় দুর্নীতি রয়েছে।তহবিল থেকে শিক্ষার্থী পরিচয়ে সহযোগিতা চেয়ে ৪৯ টি আবেদনের মধ্যে ৪৬টি আবেদনই ছিলো অবৈধ। তবে এই আবেদনগুলোর প্রত্যেকটিই গ্রহণ করা হয়। এছাড়া এসবের বাইরে ৩টি বৈধ আবেদনের মধ্যে কেবল একজন শিক্ষার্থী ১০০০ টাকা পেয়েছেন। বাকিটকাগুলো প্রাধ্যক্ষ বিভিন্নভাবে তছরূপ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কর্নারের নামে তিনি প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় দেখালেও এখানে বই বাবদ তিনি খরচ করেছেন মাত্র ৪৪ হাজার ৬৯৭ টাকা। বাকি অর্থ তিনি নিজের দোকান থেকে ক্রয় করা চড়ামূল্যের স্মারক, ফলক এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচেই ব্যয় করেছেন।
এছাড়া ২০২২ সালের শেষের দিকে ড. সুজন সেন প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্বে ছিলেন। একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর সমন্বিত হল সমাপনীর আয়োজন করা হয়। এসময় কোনো প্রকার দরপত্র আহ্বান ও ক্রেস্ট কমিটির পরামর্শ ছাড়াই একক সিদ্ধান্তে নিজের দোকান থেকে ক্রেস্ট ক্রয় করেন তিনি। ১৯০৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ১৫০ টাকার প্রস্তাবিত মূল্যে অত্যন্ত নিম্নমানের ক্রেস্ট সরবরাহ করেন তিনি। তৎকালীন এ বিষয়ে একাধিক হল প্রাধ্যক্ষ প্রতিবাদ করেছিলেন বলে জানানো হয়। স্বাধীনতা দিবসের খাবার আয়োজনের প্যাকেট থেকে শুরু করে বাবুর্চির বিলের টাকা পর্যন্ত তিনি তছরূপ করেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, তার মেয়াদকালে জিয়াউর রহমান হলে প্রকৌশল দপ্তর থেকে এককভাবে ৩৯ লক্ষ ২২ হাজার ২০৮ টাকা এবং বিভিন্ন বিভাগ ও হল মিলে সমন্বিতভাবে ১১ লক্ষ ৮১ হাজার ৭০০ টাকার কার্যাদেশ আসে। এর বাইরেও প্রায় ৩৩ লক্ষ টাকার আরেকটি কার্যাদেশ আসে বলে হল সুপার মামুনুর রহমান জানিয়েছেন। তবে সেটির কাগজপত্র ড. সুজন সেন নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। এটি তিনি হল কর্তৃপক্ষের হাতে দেননি। এসব কার্যাদেশের কাজে হল সংস্কার, ওয়াশরুমে টাইলসহ অন্যান্য কাজ যথাযথভাবে করেননি তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি ড. সুজন সেনের।
এ বিষয়ে বিভাগীয় সভাপতি অধ্যাপক ড.বনি আদম বলেন, আপনারা জানেন একজন চেয়ারম্যান চাইলেই কাউকে অব্যাহতি দিতে পারে না। আমরা অনুলিপিটা গ্রহণ করেছি। এর ভিত্তিতে বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে একটি জরুরি বৈঠকে বসবো। অধিকাংশ শিক্ষকের মতামতের ভিত্তিতে যা সিদ্ধান্ত আসবে আমি তা পেশ করতে পারবো। আগামী কালের মধ্যে আমরা বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারবো।#