মোঃ আমিনুল ইসলাম ২ এপ্রিল ২০২৪ , ১১:১৯ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড ও উন্নয়নের চাবিকাঠি। একটি জাতির আশা-আকাক্ষা রূপায়নের ও ভবিষ্যত নির্মাণের
হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। উন্নত জীবনযাপন ও সমাজের অগ্রগতি আনয়নে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর শিক্ষাকে সঠিকভাবে রূপদানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাক্রম। একটি দেশের শিক্ষা কার্যক্রম কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, কোন বিষয়বস্তু পাঠের মাধ্যমে উদ্দেশ্যসমূহ অর্জিত হবে, কোন পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা তা শিখবে এবং শিক্ষার্থীর পারদর্শিতা কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে। এ সম্পর্কিত সকল নির্দেশনার সমষ্টিই হল শিক্ষাক্রম।
একটি দেশের শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয় মূলত: সেই দেশের জাতীয় ঐতিহ্য, কৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমান ও ভবিষ্যত মানবসম্পদ গড়া ও শিক্ষার্থীদেরকে কর্মে নিয়োজিতকরণের একটি সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা থেকে। অর্থাৎ একটি জাতি তার শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে কীভাবে গড়ে তুলতে চায় তাই হলো ঐ জাতির শিক্ষা এবং শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য নির্ধারণে যে বিষয়গুলোতে সচেতনভাবে নজর দেওয়া হয় তা হলো। নাগরিকদের জাতীয় আদর্শ, সমাজের চাহিদা,
শিক্ষার্থীর প্রস্তুতি, মানসিক পরিণমন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবহারের ধরন, সামাজিক রূপান্তরের দীর্ঘমেয়াদী
পরিপ্রেক্ষিত, ভবিষ্যতের কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুত করা ইত্যাদি। এ প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীর মানসিক ও সামাজিক আশা-আকাক্ষা, জ্ঞান, দক্ষতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ; দেশপ্রেমিক ও কর্তব্যনিষ্ঠা; মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নাগরিক তৈরি, সৎ ও কর্মক্ষম জীবনযাপন, পরমতসহিষ্ণুতা ও সংবেদনশীলতা; আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা ইত্যাদিকে শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য নির্ধারণে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
স্বাধীণতার পর পরই ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হয় যা স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ১৯ বছর। এর পর ২য় বার পরিবর্তন আনা হয় ১৯৯৫ সালে। মূখস্থ নির্ভর এই কারিকুলামে প্রথমবারের মত যুক্ত করাহয় নৈর্ব্যাক্তিক প্রশ্নের যা ১৭ বছর পর্যন্ত চলমান ছিল। এই মূখস্থ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের মেধা সঠিকভাবে যাচাইকরার কোন সুযোগ ছিলনা, তাই মূখস্থ নির্ভর পড়াশুনার পরিবর্তে, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা যাচাইকরার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে ১মবারের মতো সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যার ফলশ্রুতিতে ২০১০ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। এর পর ৩য় বার কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হয় ২০১২ সালে। ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত
হয়েছে। মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থা ও জীবন যাপনে এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। কর্মক্ষেত্র ও
কর্মধারায় পরিবর্তনের ফলশ্রæতিতে মনোজগতে এসেছে পরিবর্তন যার প্রভাব পড়েছে দৈনন্দিন জীবন প্রণালিতে। এসব পরিবর্তনের সাথে নতুন প্রজন্মকে অভিযোজিত করার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান সরকার রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করে। আর এই রূপকল্পকে সামনে রেখে যোগ্যতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সর্বশেষ কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হয় ২০২৩ সালে। এই কারিকুলামের মূল লক্ষ্য হলো-মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত, দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমূখী, অভিযোজনে সক্ষম, সূখী ও বৈশ্যিক নাগরিক গড়ে তোলা। অর্থ্যাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি লালনকারী সৎ, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, আত্মবিশ্বাসী, দক্ষ, সৃজনশীল ও সুখী একটি
প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্য নিয়েই তৈরি হয়েছে বর্তমান কারিকুলাম।
এই কারিকলামের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-শিক্ষার্থীরা প্রেক্ষাপট নির্ভর অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিফলনমূলক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিমূর্ত ধারণা করে সক্রিয় পরীক্ষণে পৌঁছাতে পারবে। প্রকল্পভিত্তিক, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জভিত্তিক, অনুসন্ধানমূলক, সহযোগিতামূলক, সংযোগমূলক ও প্রেক্ষাপট নির্ভর শিখন কৌশলের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা, পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, পর্যবেক্ষণ, হাতে-কলমে কাজ, দলীয় কাজ, পঠন ও স্মৃতিতে ধারণ করে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের যেসব দক্ষতা অর্জনের উপর সবিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা হলো সুক্ষè চিন্তন দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তন দক্ষতা, সমস্যা সমাধান দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহন দক্ষতা,
যোগাযোগ দক্ষতা, স্ব-ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সহযোগিতামূলক দক্ষতা, বিশ্বনাগরিকত্ব দক্ষতা, জীবিকায়ন দক্ষতা, মৌলিক দক্ষতা, ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
কারিকুলাম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জঃ
বর্তমান কারিকুলাম নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী কারিকুলাম। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী দক্ষ নাগরিক গড়ে তুলতে হলে বিশ্বেস সকল দেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা জরুরী হয়ে পরেছিল। কিন্ত কারিকুলাম পরিবর্তনের চেয়ে তা বাস্তবায়নকরা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এই কারিকুলাম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকরা। শিক্ষকরা কোন পরিবর্তন গ্রহন করতে অভ্যস্ত না। তারা অভ্যস্ততার ভিত্তিতে ক্লাশ নিতে পছন্দ করেন তাই তাঁরা পরিবর্তনে অভ্যস্ত হতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। আবার অনেক অভিভাবক আছেন যারা কারিকুলামকে সহজে গ্রহন করতে পারছেন না। তাঁরা কারিকুলামের ইতিবাচক দিক অপেক্ষা নেতিবাচক দিক নিয়েই সমালোচনামূখর। তাঁরা ভাবছেন এই কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের বাসায় পড়তে হয়না, বাড়ির কাজ করতে হয়না, পড়ার চাপ নেই, প্রাইভেট
কোচিং করতে হয়না, পরীক্ষা নেই, পরীক্ষার খাতায় লেখা নেই, ক্লাশে ফাস্ট, সেকেন্ড নেই তাই তাঁরা ভাবেন এ আবার কেমন কারিকুলাম! এই অভিভাবকরাও আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, নোট-গাইডের বিশাল ব্যবসা ও কোচিং বাণিজ্য। নোট-গাইডের ব্যবসা ও কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত ব্যাক্তিরাও কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজননৈতিক মতপার্থত্য ও ধর্মান্ধতা। রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষকরে
বিরোধী রাজননৈতিক দলগুলো সুদূর প্রসারী চিন্তা না করে শুধুমাত্র বিরোধীতার জায়গা থেকেই বিরোধীতা করছেন যা কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।
উল্লিখিত চ্যালেঞ্জ সমূহ বিবেচনায় নিয়ে নতুন কারিকুলাম বান্তবায়নে যে সকল দিকের প্রতি নজর দিতে হবে তা হলো-
❖ নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদেকে কারিকুলামের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও
গুরুত্ব সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে এবং সকলের মাঝে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
❖ শিক্ষক প্রশিক্ষণের মান আরো উন্নত করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ে ইনহাউজ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে
হবে।
❖ বিদ্যালয়গুলো কারিকুলাম বাস্তবায়নে যথাযথভাবে কাজ করছে কি-না তা তদারক করতে হবে। প্রয়োজনে
মাস্টার ট্রেইনারদের দিয়ে দল গঠন করে মনিটরিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
❖ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হবে এবং বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে অবশ্যই
মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সংযুক্ত থাকতে হবে। বিশেষকরে প্রান্তিক এলাকার বিদ্যালয়গুলোতে এই সুযোগ সুবিধা
নিশ্চিত করতে হবে।
❖ শ্রেণি শিক্ষকদের অবশ্যই আইসিটি বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে যেন তারা মাল্টিমিডিয়ার ম্যাধমে ক্লাশ
পরিচালনা এবং সফটওয়্যারের মাধ্যমে মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।
❖ নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী সকল বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে হবে শ্রেণিকক্ষে অর্থ্যাৎ এখানে শিক্ষকদের
রয়েছে বিশাল ভ‚মিকা। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে মূল ভ‚মিকা পালন করবেন
শিক্ষকরা তাই শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায়
আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।❖ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১: ২৫ এ নামিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত
১: ৫৫। এই অনুপাত বাজায় থাকলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একক কাজ, জোড়ায় কাজ কিংবা দলীযকাজ
করানো সম্ভব নয়।
❖ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
❖ বিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদেরকে কারিকুলাম বাস্তবায়নে যথাযথ ভ‚মিকা রাখতে হবে।
যে কোন কারিকুলাম বাস্তবায়নের শুরুতে কিছু সমস্যা থাকতে পারে আর এই কারণে যদি আমরা পিছিয়ে থাকি, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যাবে, শিক্ষার্থীরা গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছাতে পারবেনা। তারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেনা। বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক কাজের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যোগ্যতাভিত্তিক এই কারিকুলামের বিকল্প নাই। তাই কারিকুলাম বাস্তবায়নের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বৈশ্বিক নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতেই হবে।
মোঃ আমিনুল ইসলাম
সহকারী শিক্ষক
রৌমারী সি. জি. জামান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়
রৌমারী, কুড়িগ্রাম।