সারাদেশ

জমিতে কুড়িয়ে পাওয়া ধানে হয় তাদের নবান্ন উৎসব

  তাসলিমুল হাসান সিয়াম,গাইবান্ধা ৪ ডিসেম্বর ২০২৩ , ৫:২৫ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ

হেমন্তের সোনাধানে মাঠ ভরে আছে। হিমেল বাতাস ঢেউ তুলে নেচে বেড়ায় সোনালি ধানের শীষ ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আর এমন সময় ধানের ক্ষেতের ভেতর মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকজন শিশু ও বৃদ্ধা । জমিতে পড়ে থাকা পাকা ধান কুড়াতেই তাদের এতো আনন্দ । কারন কুড়িয়ে পাওয়া এসব ধান দিয়েই তাদের নবান্ন উৎসব হয়।

কৃষকরা আমন ধান কেটে নেওয়ার পর মাঠে মাঠে এসব দেশি অস্ত্র হাতে ইঁদুরের গর্ত খুঁজে বেড়াচ্ছেন শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা। তাদের অনুসন্ধানী চোখ শুধু ইঁদুরের কেটে নিয়ে যাওয়া ধানের নাড়ার ফাঁক দিয়ে মাটির দিকেই নয়, খালি মাঠেও। ইঁদুরের গর্ত কিংবা ঝরে পড়া ধান দেখলেই চোখে-মুখে ফুটে উঠছে হাসি। মুহূর্তেই ইঁদুরের নিয়ে যাওয়া সেসব ধান গর্ত খুঁড়ে বের করে আনছেন, কুড়িয়ে নিচ্ছেন মাঠে পড়ে থাকা ধানও। উদ্দেশ্য নতুন ধানের চালে শীতের পিঠা তৈরি করতে হবে।

জানা যায়, গাইবান্ধা জেলার আমন ধান কাটার মৌসুম চলছে পুরোদমে। প্রতি মৌসুমের মতো এবারও চাষিরা ফসল ঘরে তোলার পর খালি মাঠে পড়ে থাকা ও ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান তুলতে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য দরিদ্র মানুষকে।

জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, আমন ধান কেটে নেওয়ার পর ক্ষেতে অবশিষ্ট পড়ে থাকা ধানের শীষ কুড়িয়ে নিচ্ছে শিশুরা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জমিতে পড়ে থাকা এসব অবশিষ্ট ধানের ছড়া থেকে ১০ থেকে ১২ কেজির মতো ধান পায় তারা। যখন ধানের পরিমাণ বেশি হবে তখন তা বিক্রি করে, কেউ আবার সে ধান মজুত করে রাখে নিজেদের জন্য। এ ছড়াও ক্ষেতে থাকা ইঁদুরের গর্তগুলো খুঁড়ে ধান বের করে তারা। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ইঁদুরের গর্তের চারপাশ খুঁড়ে এসব ধান সংগ্রহ করে শিশু ও নারীরা। এদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ধান কুড়ানো কয়েকজন নারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এভাবে দৈনিক তারা ৪-৫ কেজি ধান সংগ্রহ করেন। ধান পাকলে সাতদিনের মধ্যে মাঠের ধান কাটা শেষ হয়। এরমধ্যেই তারা ১০-১২ কেজি ধান সংগ্রহ করতে পারেন। ধান সংগ্রহের পর মাটি ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নিতে হয়। সেই ধান মেশিনে ভাঙিয়ে চালের গুঁড়ায় বানান ভাপা, মুঠো, দুধ পুলি, দুধ চিতইসহ বিভিন্ন ধরনের পিঠা। এক সময় ঢেঁকিতে ধান ভানার প্রচলন থাকলেও এখন তা বিলুপ্ত।

আরিফখা গ্রামের শিউলি বেগম জানান, “শীত এসেছে পিঠা খাবো। আমার আবাদি জমি নাই। এবার যত ধান কুড়িয়ে পাইছি পিঠা খেতে পারবো।”

একই গ্রামের কদুভান বেগম বলেন, “আমরা ছোটবেলায় পাড়ার সকল মেয়েরা দল বেঁধে এভাবে ধান কুড়াতাম। এখনকার মেয়েরা চড়ায় (মাঠে) আসে না। আগের মতো সেই আনন্দ এখন আর নেই। ২ মেয়ে, জামাই আছে ও নাতি নাতনিদের পিঠা খাওয়ানোর জন্য ধান কুড়াই। গরীব মানুষ কিনে আনার মতো সামর্থ্য নাই। যে ধান পেয়েছি সবাই মিলে পিঠা খেতে পারবো।”

স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মরিয়ম আক্তার জানায় , “স্কুল থেকে এসে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ও কুড়িয়ে ধান সংগ্রহ করি। এগুলো বিক্রি করে মা-বাবা সংসারে টাকা কাজে লাগে। কখনো মনে চাইলে পিঠা তৈরি করেও খাই। ধান কাটার সময় মালিক ক্ষেতে নামতে দেন না। কেটে নিয়ে যাওয়ার পর পড়ে থাকা ধানগুলো কুড়িয়ে থাকি। ইঁদুরের গর্ত খুঁড়েও বের করে আনি।”

গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ খোরশেদ আলম বলেন, ‘গাইবান্ধার ৭ উপজেলায় আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। এখন ধান কাটা-মাড়াই চলছে। কৃষকদের প্রণোদনাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। কৃষি বিভাগ সব সময় কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে।