মোঃ শাহাদাত হোসেন মনু,ঝালকাঠি ৮ ডিসেম্বর ২০২৩ , ১:০৪ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
আজ ৮ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এ দিনে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা থেকে মুক্তি পায় ঝালকাঠিবাসি। জেলার প্রায় অর্ধশত স্থানে নিরীহ বাঙালিকে ধরে গুলি করে পাকহানাদাররা।
মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা ও সংশি¬ষ্টদের দেয়া স্মৃতি নির্ভর তথ্যে জানাগেছে, ১৯৭১ সালের ২৩মার্চ স্থানীয় পুরাতন স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর পরপরই স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। পাশাপাশি প্রাথমিকভাবে বরিশাল থেকে সংগৃহিত স্বল্প সংখ্যক রাইফেল ও ক’টি বন্দুক দিয়ে শুরু হয় মুক্তিবাহিনী গঠনের কাজ। এতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সহায়তা করেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা।
এরই এক পর্যায়ে পাকিস্তানী হানাদারদের রূখতে মুক্তিপাগল স্বতঃস্ফুর্ত যুবকের সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে অবশেষে বন্দুকের সাদৃশ্য কাঠের অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণ কাজ চালাতে হয়। এভাবেই ছোট ছোট কটি মুক্তিবাহিনীর দল গঠিত হয়। এর মধ্যে পৃথক পৃথকভাবে একেকটি দলের নেতৃত্বে ছিলেন সর্বহারা পার্টির সিরাজ সিকদার, সেলিম শাহনাজ, কির্ত্তীপাশা ইউনিয়নের মানিক প্রমুখ। শেষ পর্যন্ত এই মানিকের নেতৃত্বাধীন ২৪সদস্যের দলটি স্থানীয়ভাবে মানিকবাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এরপর ১মাস ৪দিনের মাথায় ২৭এপ্রিল সন্ধ্যায় ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক হানাদারদের একটি দল গানবোটযোগে এসে শহর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথমে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে।
বর্বরদের ভারী অস্ত্রের কাছে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাসহ শহরবাসী যে যেভাবে পেরেছে শহর ছেড়ে আত্মরক্ষার্থে অজানা গন্তব্যে চলে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছে অসংখ্য অসহায় লোক। স্থানীয় কতিপয় পদলেহী বাঙালীর পরামর্শে বেছে বেছে কয়েকটি বাড়িঘর রেখে এককালের ঐতিহ্যবাহী “দ্বিতীয় কলকাতা খ্যাত” ঝালকাঠি বন্দর জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী। টানা ৩ দিন ধরে জ্বলতে থাকা এ আগুনের লেলিহান শিখা ১২/১৫ মাইল দূর থেকেও মানুষ দেখতে পেয়েছে। ফলে পাকিস্তানী বর্বর উম্মত্তদের তান্ডবে শত বছরের গড়া ঝালকাঠি বন্দরবাসীর সোনার সংসার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে যায়। ১৬জুন প্রায় ৫শতাধিক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বেশাইনখানের মানিক বাহিনীর ২৪জনের পুরো দলটিকে ধরে এনে নিষ্ঠুর নির্যাতনের পর হত্যা করে।
এভাবেই তথাকথিত শান্তি (পিস) কমিটির অথবা পাকিস্তানী দালাল রাজাকারদের সহায়তায় ৭ডিসেম্বর পর্যন্ত নৃশংস বর্বরতা চালিয়ে গোটা ঝালকাঠির মানুষকে নিঃস্ব করে ও ধর্ষণ, লুটতরাজ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকান্ডের নিষ্ঠুরতার স্বাক্ষর রেেেখ যায় হানাদার বাহিনীর দস্যুরা। কালের স্বাক্ষী হয়ে সুগন্ধা প্রবাহমান থাকলেও তারই করাল গ্রাসে বিলীন আর সারিবদ্ধভাবে শত শত মানুষকে গুলি ও কসাইর মত জবাই করে হত্যা করার সেই বধ্যভূমিটি।
দেশকে শত্রæমুক্ত করার প্রাণপণ এই লাড়াইর এক পর্যায়ে ৭ডিসেম্বর পাক বাহিনী ঝালকাঠির উত্তরাঞ্চলে অভিযান শেষে সুগন্ধা নদী দিয়ে নৌ-পথে বরিশাল যাবার সময় শহরের কাঠপট্টি এলাকার চরে ৩০জন রাজাকারকে নামিয়ে দেয়। ওই দিন কতিপয় নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা লাঠি হাতে পিছন থেকে রাজাকার দলটিকে “হ্যান্ডসআপ” বলা মাত্রই রাজাকাররা হাতের অস্ত্র ফেলে দু’হাত উপরে তোলে আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিপাগল মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেললে “টিক্কাখান” নামে পরিচিত আঃবারেক নামের এক রাজাকার প্রতিবাদ করলে বিক্ষুদ্ধ জনতা গণধোলাই দিয়ে তার চোখ উপড়ে ফেলে। সন্ধ্যায় টিক্কাখান নামের সেই রাজাকার মারা যায়। ধৃত বাকি রাজাকারদের গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। আর এরই মধ্য দিয়ে রক্তপাতহীন শান্ত পরিবেশে ৮ ডিসেম্বর ঝালকাঠি ও নলছিটি হানাদার মুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বীরমুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ।