এস এম রাফি ২৯ জুন ২০২৩ , ৯:৩১ পূর্বাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
ঈদুল আজহার বড় আয়োজনই পশু জবাই ও মাংস কাটা। ফলে এই সময়টাতে খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে কসাইদের। আর রাজধানী ঢাকায় কসাইয়ের সংকট থাকে কোরবানির সময়ে। ফলে প্রতি বছরই উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে বাড়তি উপার্জনের আশায় ঢাকায় যান এই পেশার মানুষ।
এবারও দিনাজপুর থেকে প্রায় দুই হাজার কসাই ছুটেছেন ঢাকায়। গত দুই দিন ধরেই এই জেলা থেকে কসাইরা যাচ্ছেন বাস ও ট্রেনে করে। আবার কেউ কেউ যাচ্ছেন বিমানেও। যারা ঢাকায় যাচ্ছেন তারা মূলত চুক্তিভিত্তিক। এই দুই দিনে তাদের প্রতিজনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ন্যূনতম ৩০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। তাদের মতে, এই সময়টাতে ঢাকায় গিয়ে তাদের একটি বাড়তি আয় হয়। আর যারা বিমানে করে ঢাকায় যায় তাদের বিমান ভাড়ার অর্ধেক দিয়ে দেয় চুক্তিকারীরাই।
কসাইরা জানিয়েছেন, এবার প্রতি হাজারে পশু জবাই ও মাংস কাটার রেট ধরা হয়েছে ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। অর্থাৎ যদি পশুর দাম এক হাজার টাকা হয় তাহলে তাদেরকে দিতে হবে ২০০-২৫০ টাকা। এতে এক লাখ টাকার পশুর জন্য কসাইকে দিতে হবে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। একইসঙ্গে ওই দুই দিনে তাদের থাকা ও খাওয়া দিতে হবে চুক্তিকারীদের।
দিনাজপুর থেকে যারা এই সময়টাতে ঢাকা যান তাদেরকে বাড়তি চাপ নিতে হয় না। বরং খুব সুবিধাতে কম খরচেই তারা ঢাকায় যেতে পারেন। এই সময়টাতে ঢাকা যাওয়ার জন্য বাস ও ট্রেনেও চাপ নেই। বিমানেও একই অবস্থা। বরং কম মূল্যেই পাওয়া যায় টিকিট। এই দুই দিনে তাদের যে বাড়তি উপার্জন হয় তা দিয়েই তারা আগামী দেড় থেকে দুই মাস চলতে পারেন। কারণ কোরবানির পরে মাংসের দোকানগুলোতে আয়-উপার্জন কিংবা মাংস কেনাবেচায় ভাটা পড়ে। ভাটা পড়ে উপার্জনেও।
দিনাজপুর জেলার অন্যতম মাংসের বাজার বসে বাহাদুরবাজার এলাকায়। সেখানকার কসাই মংলা বলেন, প্রতি বছরই এখান থেকে কিছু কসাই ঢাকায় যায়। কোরবানির একদিন আগেই তারা যায়। কোরবানির দিন কাজ করে, কেউ কেউ পরের দিন পর্যন্ত করে। পরে ফিরে আসে। মূলত এই সময়ে ঢাকায় কসাইয়ের চাহিদা বেশি, উপার্জনও ভালো। ঢাকাতে আমাদের ৩০/৩২ জন যায়। চুক্তিভিত্তিক তারা যায়। দিনাজপুরে পায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। আর ঢাকাতে গেলে পায় ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা।
আরেক কসাই সফিকুল ইসলাম বলেন, আমি চার বছর আগে চুক্তিতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। ওই সময়ে ২০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। কিন্তু খাটুনি অনেক বেশি। সকাল থেকে দিন পেরিয়ে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। তখন আমার নিজস্ব দোকান ছিল না, তাই যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু এখন নিজস্ব দোকান, তাই আর যেতে পারি না। অনেকেই যায়। বিমানে অনেকেই যায়। রাতে দোকানে কাজ শেষে বিমানে করে ঢাকায় চলে যায়। আবার দুই দিন কাজ করে ফিরে আসে। এতে তাদের বাড়তি উপার্জন হয়। কারণ কোরবানির পর দোকানে তেমন কাজ থাকে না।
কসাই আজাহার আলী বলেন, এ পর্যন্ত চারবার বিমানে ঢাকায় গিয়েছি। আজ রাতেও যাবো। সেখানে কাজ হাজারে ২০০ টাকা… আর দিনাজপুরে ৫০ টাকা মাত্র, ১০০ টাকাও দিতে চায় না। এ জন্য আমরা ঢাকায় যাই।
একটু বুঝিয়ে তিনি বলেন, যদি একটি গরুর দাম এক হাজার টাকা হয় তাহলে আমাদের ওই গরু জবাই করে মাংস তৈরিতে দিতে হবে ২০০ টাকা। প্রতি বছরে এই বাজার থেকে প্রায় ৩০ জনের মতো যাই। ঢাকায় গেলে দুই দিন কাজ করি। এতে করে আমি পাবো প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এই দুই দিনে আমি কমপক্ষে ৪০টি গরু বানাবো।
মোহাম্মদ শাকিল বলেন, এখান থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫০ জন কর্মচারী চলে যায়। যারা এখানকার কর্মচারী, তারা তো কম আয়ের মানুষ। এ জন্য আমরাও তাদেরকে ঢাকায় যেতে দেই। এই সময়ে তাদের একটা বাড়তি উপার্জন হয়। ঢাকার বড় বড় কসাইয়ের সঙ্গে তাদের পরিচয়, যারা এই কাজে নিযুক্ত করে। আমার দুই কর্মচারী ঢাকায় গেছে, তাদেরকে দুই দিনে ৮০ হাজার টাকা দেবে বলে চুক্তি হয়েছে। আমাদের অনেকেই বিমানে যায়, অনেকেই বাসে করে যায়। এই সময়ে তো ঢাকায় বাসে করে যাওয়া সুবিধা, আবার আসাও সুবিধা।
মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, দুই বছর আগে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম। আমাকে চুক্তি করে নিয়ে গিয়েছিলেন এক কসাই। ঈদের দিন রাত ১২টা থেকে ভোর পর্যন্ত কাজ করতে হয়। পরের দিনও বিকাল পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সিস্টেম আছে, গরু জবাই করে শুধু চামড়া ছাড়ানো, আবার গরু চার পিস করা, আবার ছোট ছোট পিস করা। এর সবই আলাদা আলাদা রেট রয়েছে। আমরা ট্রেনে যাই, বাসে যাই।
সোহেল বলেন, ঈদের আগের দিন পর্যন্ত দোকানদারি হয়। এ জন্য অল্প সময়ে মেকআপ করার জন্য অনেকেই বিমানে করে ঢাকায় যায়। ট্রেনে বা বাসে করে গেলে তো সময় কুলানো যাবে না। এই বিমানের খরচাটাও ঢাকার বড় বড় কসাইরা দেন।
মাংস বাজার কমিটির নির্বাহী সদস্য আবু সাঈদ বলেন, এখানে একটি গরু তৈরি করে দিলে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। আর ঢাকায় একটা গরু তৈরি করে দিলে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এ জন্য অনেকেই ঢাকায় যায়। কসাইরা ঢাকায় যাওয়ায় দিনাজপুরে কিছু সমস্যা হয়। সংকট পড়ে। কিন্তু কিছু করার নাই। যারা এখানে কাজ করেন তাদের হয়তো কোরবানির দিনে উপার্জন হয় এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আর যারা ঢাকায় যায় তাদের দুই দিনের উপার্জন কমপক্ষে ৬০ হাজার টাকা।
কমিটির সভাপতি আসলাম হোসেন বলেন, কিছু ট্রেনে যায়, কিছু বাসে যায়। যারা ছাড়া পড়ে যায় তারা বিমানে করে যায়। দোকানে কাজ থাকলে কারও কারও যেতে দেরি হয়। তখন তাদেরকে দ্রুত বিমানে করে পাঠানো হয়। যারা চুক্তি করেন তারা অর্ধেক দেন, আর আমরা অর্ধেক দেই। বাহাদুরবাজার, রেলওয়ে বাজার, রামনগর, মহারাজা মোড়, গোপালগঞ্জ বাজার, নিউ টাউনসহ বিভিন্ন বাজার থেকে কসাইরা ঢাকায় যায়।
সূত্রঃ বাংলা ট্রিবিউন