রাজনীতি

বিএনপির সঙ্গে কথা বলার কিছু নাই- ​প্রধানমন্ত্রী

  এস এম রাফি ৩ মে ২০২৩ , ১২:৫২ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ

সদরুল আইনঃ

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে আগেও বারবার আলোচনা করেছি। তাদের সঙ্গে আর কথা বলার মতো কিছু নাই। ওদের সঙ্গে আর বসতে ইচ্ছা করে না।ওদের সঙ্গে বসলে যেন পোড়া মানুষের গন্ধ পাই।

যুক্তরাষ্ট্রে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সার্ভিসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়।

বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের অংশীদারিত্বের ৫০ বছর উদযাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ওয়াশিংটন সফরে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।সোমবার সংস্থাটির সদর দফতরে আনুষ্ঠানিক আয়োজনে যোগ দেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একে তো সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তারপর আবার আমার বাবা-মা-ভাই-বোনদের খুনি… তারপরও দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য কিন্তু আমি অনেক অনেক উদারতা দেখিয়েছি। তবে এখন আর তাদের (বিএনপি) সঙ্গে কথা বলার মতো কিছু নাই।

সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়, নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করছে, বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কোনো আলোচনার চিন্তাভাবনা কি আপনাদের আছে?

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কিন্তু বারবার বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছি, ২০১৮ এর নির্বাচনেও।

আসলে বিএনপি এমন একটা রাজনৈতিক দল, এই দলটা সৃষ্টি করেছে একজন মিলিটারি ডিক্টেটর, যে ১৯৭৫ সালে আমার বাবা-মা-ভাই-বোনদের হত্যা করে।

একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং ক্ষমতায় আসার আগে তিনি কিন্তু যখন আমার বাবাকে হত্যা করা হলো, তারপর যিনি ক্ষমতায়, তাকে সরাল, তার পরে আরেকজন চিফ জাস্টিস সায়েম, তাকে সরিয়ে অস্ত্র হাতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসে।

তারপর তিনি একটা রাজনৈতিক দল করে। একজন সেনাপ্রধান নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে চেয়ারে বসল, তারপর হ্যাঁ/না ভোটের নামে নাটক করা হলো…। এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, অস্ত্র হাতে নিয়ে ক্ষমতা দখল করে, ক্ষমতায় বসে থেকে যে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেছে, সেটাই হচ্ছে বিএনপি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮-এর নির্বাচন নিয়ে কিন্তু কারও কোনো অভিযোগ নেই। তখন আমাদের ছিল ১৪ দলীয় জোট, আর বিএনপির নেতৃত্বে ছিল ২০ দলীয় জোট। তাদের জোট ৩০০ সিটের মধ্যে পেয়েছিল ২৯টা, বাকি সিটগুলো কিন্তু আমরা পেলাম। সেটা থেকেই তো বিএনপির অবস্থানটা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।

যার ফলে তারা ২০১৪ সালে আর ইলেকশন করবে না, ইলেকশন ঠেকাবে। ইলেকশন ঠেকাতে গিয়ে শুরু করল অগ্নিসন্ত্রাস। এটা মনে হয় কোনো মানুষ ভাবতে পারবে না যে, জীবন্ত মানুষগুলো বাসে করে যাচ্ছে, সেখানে তারা আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে, ট্রাকে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে, লঞ্চে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে, গাড়ি, সিএনজি…।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ৩ হাজার ৮০০ গাড়িতে তারা আগুন দিয়েছে। ২৯টা ট্রেনে আগুন দিয়েছে। সিএনজি, প্রাইভেট কার, যাকে যেখানে পেত, গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারাই নাকি তাদের আন্দোলন!

৫০০টা স্কুল তারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল আগুন দিয়ে এবং ৭০টা সরকারি অফিস, ৬টা ভূমি অফিস তারা আগুন দিয়ে জ্বালাল, এভাবে তারা ইলেকশন বন্ধ করার চেষ্টা করল। কিন্তু আসলে জনমতের শক্তিটাই সবচেয়ে বড়।

কাজেই ইলেকশন বন্ধ করতে পারেনি, আমরা ক্ষমতায় ফিরে আসলাম। বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা গেল যখন, লাশ এসেছে, মানবিক কারণে আমি প্রাইম মিনিস্টার, তার পরও আমি গেলাম, সন্তানহারা মাকে সহানুভূতি জানাব…।

আমি যখন রওনা হলাম, প্রথমে বলা হলো আমার গাড়ি ওই বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেবে না। মেইন গেট বন্ধ, যেখানে আমি চলে আসছি কাঁচি গেটে। খবর এলো যে, ওই গেট দিয়ে ঢুকতে দেবে না। তখন আমি বললাম, যেহেতু এসেই গেছি, মেইন গেট না খুললেও পকেট গেট দিয়েই যাব। আমার গাড়িটা দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার যে অন ডিউটি এসএসএফ ভিতরে ছিল, সে জাস্ট গেট থেকে একটু বের হয়ে এসেছে আমাকে নেওয়ার জন্য, পেছনে চট করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমাকে ঢুকতে দিল না।

আমি তা-ও গাড়ি থেকে নামলাম। নেমে দেখি, তাদের লোকজন ভিতরে। আমাকে ঢুকতে না দিয়ে অপমান করা হলো। এখন আপনারা বলেন, এরপর কার সঙ্গে ডায়ালগ করব আমি? ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয় তা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পর প্রত্যেকটা পরিবার যে কষ্ট পাচ্ছে… আর যারা পোড়ার পর বেঁচে আছে, তাদের সবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলাম। যে অবস্থায় তারা আছে, সেই অবস্থা যদি কেউ চোখে দেখে… তখন আর ওদের (বিএনপি) সঙ্গে বসতে ইচ্ছা হয় না। মনে হয় ওদের সঙ্গে বসলে যেন ওই পোড়া মানুষগুলোর পোড়া গন্ধ পাই।

র‌্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ খুব বেশি শুরু হয়ে গেল, আমেরিকায় যখন টুইন টাওয়ারে আক্রমণ হলো, তখন আমেরিকার পরামর্শেই র‌্যাব সৃষ্টি হলো। র‌্যাবের ট্রেইনিংসহ সবকিছুই কিন্তু আমেরিকার করা।

যখন আওয়ামী লীগ সরকার আসল এবং একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রাখলাম, তখন হঠাৎ করে র‌্যাবের ওপর এই স্যাংশনটা তারা কেন যে জারি করল, সেটা ঠিক আমার কাছে বোধগম্য না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর র‌্যাবের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে তাদের যেসব ভূমিকা ছিল, সেটা খুবই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।

কিন্তু আওয়ামী লীগ আসার পরে কিন্তু র‌্যাবের কোনো অফিসারও যদি কোনো অপরাধ করে, তাদের কিন্তু বিচার হয়… এটা কিন্তু অন্য দেশে নেই। এমনকি আমি বলব, আমেরিকায়ও নেই। আমাদের দেশে তো এই আইনের শাসনটা বলবৎ আছে এবং যারা যখনই কোনো রকম অপরাধমূলক কাজ করেছে, আমরা কিন্তু তাদের শাস্তি দিয়েছি।

র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ দিতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় প্রতিমন্ত্রীর জামাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সঙ্গে সঙ্গে তাকে কিন্তু গ্রেফতার করা হয়েছে, জেলে দেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সে শাস্তি পেয়েছে। আমরা এভাবেই কিন্তু দেখি।

কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এভাবে হঠাৎ স্যাংশন দেওয়ার ফলে যেটা হলো, এতে জঙ্গিরা একটু বোধহয় উৎসাহিত হয়ে পড়ল- এটা হলো বাস্তবতা। ’ বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর সব দেশে এমন আইন আছে, যা বাংলাদেশেও করা হয়েছে।

কোনো গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে এ আইন করা হয়নি, বরং যিনি অপরাধ করেন, তাকেই এর আওতায় আনা হয়। নাগরিকদের ডিজিটাল ক্ষেত্রে বিচরণ সুরক্ষিত করতে এ আইন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুধু বাংলাদেশে নেই; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেরও এমন আইন রয়েছে।

সাংবাদিকদের হয়রানি করা এ আইনের লক্ষ্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে যদি কেউ অসামাজিক কার্যক্রম, উসকানিমূলক কার্যক্রম, জঙ্গিবাদী কার্যক্রম করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেউ যদি এখন আমার একটি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ফাইল চুরির চেষ্টা করে, তাকে কি পুরস্কৃত করতে হবে? কোনো সভ্য দেশে এটা করলে কী ব্যবস্থা হয় তার বিরুদ্ধে?

যখন সমগ্র বিশ্ব কভিড-১৯-এর কারণে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল ছিল এবং আমরা ভ্যাকসিন কেনা নিয়ে আলোচনা করছিলাম; তখন একজন কর্মকর্তা এই ফাইল চোরকে ধরে ফেলেন। হাতেনাতে ধরা পড়া সত্ত্বেও দেখলাম তাকে হিরো বানানো হলো, তাকে আবার পুরস্কার দেওয়া হলো!

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আগের চেয়ে বেশি ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১২-১৩ কোটির সিমকার্ড রয়েছে। অনেক সমস্যা আছে। অনলাইনে শেখানো হচ্ছে কীভাবে বোমা তৈরি করতে হয়, কীভাবে মানুষ মারতে হয়। এগুলো বন্ধ করা দরকার।

আমি মনে করি আন্তর্জাতিকভাবে এ বিষয়ে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। যারা অনলাইনে এ ধরনের অপরাধে শিশু-কিশোরদের জড়িত করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। আমাদের দেশে আগে একটা আইন ছিল, যখন সামরিক স্বৈরশাসক ক্ষমতায় ছিল, যার অধীনে যে কোনো সাংবাদিককে বিনা সমনে গ্রেফতার করা যেত। আমি (আওয়ামী লীগ সরকার) দায়িত্ব নেওয়ার পর এটা বন্ধ করে দিয়েছি। আইন সংস্কারের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের আইনটা কিন্তু অনেক সহজ অন্যান্য দেশের থেকে।

তারপরও আমরা বলছি, অন্যান্য সভ্য দেশে আইনটা কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে, তা আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি। তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে তাঁর কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবশ্যই। আমরা বারবার যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য বিএনপির দণ্ডপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, তবে সবকিছু নির্ভর করছে যুক্তরাজ্য সরকারের ওপর।

তিনি (তারেক রহমান) সেখানে (ইউকে) আছেন। অপরাধী যেই হোক, তাদের ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন এটা সম্পূর্ণ ব্রিটিশ সরকারের ওপর নির্ভর করছে। তারা কি তাকে সেখানে রাখবে নাকি শাস্তি কার্যকর হতে দেবে, এটা সম্পূর্ণভাবে তাদের ওপর নির্ভর করছে।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সর্বদা উদ্যোগ রয়েছে। মানি লন্ডারিং, অস্ত্র চোরাচালান, দুর্নীতি এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারেকের বিরুদ্ধে এমন আরও অনেক মামলা বিচারাধীন। তারেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বন্ডে সই করে দেশ ত্যাগ করেন। তাই আমরা চাই এই মামলার রায় কার্যকর করতে যত দ্রুত সম্ভব তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক।