আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ২১ এপ্রিল ২০২৫ , ৫:২৮ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র—ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে প্রস্তাবিত স্থলপথ সংযোগ, যার মাধ্যমে পক প্রণালী পেরিয়ে একটি সেতু বা করিডোর নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছিল, তা আপাতত স্থগিত করে দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক কলম্বো সফরের সময় বিষয়টি অগ্রাধিকার পেলেও, শ্রীলঙ্কা সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্পষ্ট করা হয়েছে যে তারা বর্তমানে এই প্রকল্পে এগোতে প্রস্তুত নয়।
প্রস্তাবিত স্থল সংযোগটি আলোচনায় আসে ২০০২–২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের সময়। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২৩ সালে নয়াদিল্লি সফরের সময়ও বিষয়টি যৌথ বিবৃতিতে পুনরায় উঠে আসে। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতি অনুরা কুমারা ডিসানায়েকের দিল্লি সফরে এটি এজেন্ডা থেকে বাদ পড়ে।
সাম্প্রতিক ভারত-শ্রীলঙ্কা দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় মোদি পক প্রণালীর ওপরে সেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎ গ্রিড এবং ত্রিনকমালেতে ১২০ মেগাওয়াট সৌর প্রকল্পসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এমনকি তিনি হেলিকপ্টার থেকে ‘রাম সেতু’ পর্যবেক্ষণ করেন—যা হিন্দু ধর্মীয় পুরাণে ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সংযোগ হিসেবে বিবেচিত।
তবে শ্রীলঙ্কার নীতিনির্ধারকেরা এই স্থলপথ পরিকল্পনার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। কলম্বোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, প্রস্তাবটি যদিও ভারত-শ্রীলঙ্কা বাণিজ্য ও পর্যটনের উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে, তবুও পরিবেশগত ঝুঁকি, আর্থিক দায় এবং জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে এটি আপাতত গৃহীত নয়। মান্নার উপসাগরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণাগার, প্রবাল প্রাচীর, মাছের প্রজনন কেন্দ্র এবং পরিযায়ী পাখির আবাসস্থলসহ বিভিন্ন সংবেদনশীল অঞ্চল এই সেতুর আওতায় পড়ে যাবে—যা শ্রীলঙ্কার পরিবেশবাদী মহলে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কা এখনও অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে সংগ্রাম করছে। বিশাল মূলধন ব্যয়ের এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে তাত্ত্বিক লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ জরুরি। শ্রীলঙ্কার এক মন্ত্রিপরিষদ কর্মকর্তার মতে, “বিদেশি অর্থায়ন এবং জটিল কূটনৈতিক সমঝোতা ছাড়াও আমাদের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।”
এই স্থলপথ প্রকল্পটি ভারতের বৃহত্তর আঞ্চলিক যোগাযোগ পরিকল্পনার অংশ, বিশেষ করে বিমসটেক কাঠামোর মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ জোরদারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ভারতীয় কৌশলবিদরা মনে করেন, স্থলপথটি বিমান এবং নৌপথের পরিবেশবান্ধব বিকল্প হতে পারে এবং নেট-জিরো কার্বনের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে শ্রীলঙ্কার সংবেদনশীল সামুদ্রিক অঞ্চলজুড়ে যথাযথ পরিবেশগত মূল্যায়ন ও জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি।
শ্রীলঙ্কার স্থল সংযোগ নিয়ে অনীহা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকেও ইঙ্গিত করে, যারা বর্তমানে দেশটির বন্দর ও সামুদ্রিক অবকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগ করছে। কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখা শ্রীলঙ্কার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাই এমন সংযোগ কেবল প্রযুক্তিগতভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবেও চূড়ান্ত ঐক্যমতের ভিত্তিতে এগোতে হবে।
তবে ভারতের পক্ষ থেকে এখনো আশা রয়েছে যে ভবিষ্যতে পরিবেশ-বান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই মডেলে ফেরি সার্ভিস, সবুজ শিপিং করিডোর বা কম ক্ষতিকর বিমান সংযোগের মাধ্যমে সহযোগিতা গড়ে তোলা যাবে।
এই সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—সংযোগ কেবল সেতু বা রাস্তায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি আস্থা, পরিবেশ সচেতনতা, অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিপক্বতার ওপরও নির্ভর করে। আপাতত, পক প্রণালীজুড়ে একটি স্থলসেতুর স্বপ্ন স্থগিত হয়েছে—তবে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা একেবারে নাকচ হয়ে যায়নি।