রাজনীতি

মহাসমাবেশ ঘিরে একগুচ্ছ পরিকল্পনা বিএনপির

  এস এম রাফি ২৫ অক্টোবর ২০২৩ , ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ

আগামী ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বিএনপি। যে কোনো মূল্যে ঢাকার নয়াপল্টনে এই কর্মসূচি পালনে বদ্ধপরিকর তারা। সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। মহাসমাবেশের আগে ও পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের তৎপরতা ও মনোভাব বুঝে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা।

তারা জানান, শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সফল করাই এই মুহূর্তে তাদের মূল লক্ষ্য। বিএনপি আগ বাড়িয়ে কোনো সংঘাতে যাবে না—দলের প্রতিটি পর্যায়ে নেতাকর্মীদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে এবার কোনো বাধা এলে তা প্রতিহত করতে তৃণমূলে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে এখন বিএনপির স্লোগান ‘চলো চলো, ঢাকা চলো’।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপির হাইকমান্ড এবারের আন্দোলনকে ‘বাঁচা মরার লড়াই’ হিসেবে বিবেচনা করছে। সেই লক্ষ্যেই বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখা হয়েছে। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এসব কর্মসূচিতে দলটির মূল লক্ষ্য ছিল দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সরকারবিরোধী সব দলকে একই ছাতার নিচে আনা। পাশাপাশি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির পক্ষে দেশ-বিদেশে জনমত তৈরিরও চেষ্টা করেছেন তারা।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, ইতোমধ্যেই সেই লক্ষ্য পূরণে সক্ষম হয়েছেন তারা। এতদিন অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। এখন রাজপথ নিয়ন্ত্রণ করেই তারা সামনে অগ্রসর হবেন। আগামী ২৮ অক্টোবর থেকে সেই ‘মহাযাত্রা’ শুরু হবে। মহাসমাবেশ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের আচরণ কেমন হয়—তা দেখেই পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করবে বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এবারের আন্দোলন একটি পরিণতির দিকে যাচ্ছে এবং জনগণের বিজয় অনিবার্য। আওয়ামী লীগ যতই ভয়ভীতি দেখাক, জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন আটকাতে পারবে না।’

তিনি বলেন, ‘২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ হবে। এটা শুধু একটি দলের বিষয় নয়। প্রায় ৩৪টি দল সমাবেশ ডেকেছে। এটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ।’

জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীও এবার যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের পাশাপাশি তারাও রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীকে ২৮ অক্টোবরের পরিবর্তে পুলিশ অন্য কোনো দিন সমাবেশের অনুমতি দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বাইরে অন্যান্য ইসলামিক দল ও ডান-বামসহ সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে চলমান যুগপৎ ধারার এক দফার আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টায় আছে বিএনপি। এর মধ্যে কোনো কোনো দল ২৮ অক্টোবর নিজস্ব কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। একই মঞ্চে না পেলেও জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস এবং হেফাজতে ইসলাম আলাদা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামায় উজ্জীবিত বিএনপি। জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতাকেও ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিএনপি।

বিএনপি ঘোষিত আন্দোলনের মহাযাত্রার ধরন সম্পর্কে দলটির একাধিক নেতা দৈনিক কালবেলাকে জানান, এক দফার আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে ইতোমধ্যেই দলের হাইকমান্ড বিভিন্ন জোট ও রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের মতামত নিয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। গত রাতেও দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে পরবর্তী কর্মসূচিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে নেতাকর্মীদের ধরপাকড় এবং খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, চূড়ান্ত কর্মসূচির অংশ হিসেবে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের একটি অংশ মহাসমাবেশের পর ২৯ বা ৩০ অক্টোবর ঢাকায় বড় কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো, গত ২৮ জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সমবেত হলেও তারা সেখান থেকে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা পাননি। পরদিন কর্মসূচি দেওয়া হলেও ততক্ষণে তৃণমূলের অধিকাংশ নেতাকর্মী ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এবার যেন সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়।

তবে মিত্রদের আরেকটি অংশ আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারকে ক্ষমতা ছাড়ার চূড়ান্ত আলটিমেটাম দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে সরকার সাড়া না দিলে ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ ঘিরে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত টানা কর্মসূচি দেওয়ার প্রস্তাব তাদের। তবে আন্দোলনের মাঝে কোনো বিরতি না দিয়ে মহাসমাবেশের পরদিনই সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে জানা গেছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশে জনতার স্রোত নামাতে চাই। দাবি আদায়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাই। সরকারের আচরণ ও পরিস্থিতিই বলে দেবে—পরবর্তী কর্মসূচির ধরন কী হবে?’

বিএনপি নেতারা জানান, ঢাকায় মহাসমাবেশ বাধাগ্রস্ত করতে ক্ষমতাসীন দল কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও সেসব কাটিয়ে উঠতে কী কৌশল নিতে পারে তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। যদিও দলের কেউ কেউ মনে করছেন, বৈশ্বিক চাপে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। আগের মতো এবারের মহাসমাবেশে সরকার বাধা দেবে না।

তবে বেশিরভাগ নেতার ধারণা, পূজার ছুটির পর ধরপাকড় আরও বাড়বে। যারা নেতৃত্ব দিতে পারেন এবং বেশি লোকসমাগম ঘটাবেন এমন নেতাদের টার্গেট করে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তবে গ্রেপ্তার-নির্যাতনে এবার আর তারা থেমে যাবেন না। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, সরকার বাধা দিলেই তারা আর ঘরে ফিরে যাবেন না।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক বলেন, ‘আমরা ১৬-১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। বুকে অনেক সাহস নিয়ে অনেক মিথ্যা ও আজগুবি মামলা নিয়েও বেঁচে আছি। অজস্র সহকর্মীকে হারিয়েছি। প্রয়োজনে ২৮ অক্টোবরে আরও প্রাণ দেব, তবু এই সরকারকে ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হবে না।’

দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, ‘আমাদের তো হারানোর কিছু নেই। গত ১৫ বছর ধরে নেতাকর্মীদের নামে অসংখ্য মিথ্যা ও গায়েবি মামলা হয়েছে। অনেকেই কারাগারে গেছেন, হামলার শিকার হয়েছেন। নিজেদের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ধ্বংসের মুখে। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ। আয়-রোজগার নেই। এমন অবস্থায় এবারের আন্দোলন হবে বাঁচা-মরার লড়াই।’

জানা গেছে, গত ১৬ অক্টোবর যুবদলের সমাবেশ এবং ১৮ অক্টোবর বিএনপির জনসমাবেশে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের অনেকেই এখনো ঢাকায় রয়ে গেছেন। এরপর মহাসমাবেশে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরাও এলাকায় ফিরবেন না।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল জানান, এই মুহূর্তে তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের উসকানিতে পা না দিয়ে ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে সফল করা।

মাদারীপুরের শিবচর উপেজলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান বলেন, তারা সবকিছু উপেক্ষা করে নতুন জীবনের আশায় এবার নিজেদের সর্বোচ্চ ভূমিকা নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

চলছে একের পর এক প্রস্তুতি
মহাসমাবেশ সফল করতে ধারাবাহিকভাবে প্রস্তুতি সভা করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। গতকাল নয়াপল্টনে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতার সভাপতিত্বে প্রস্তুতি সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির প্রস্তুতি সভায় বক্তৃতা করেন দক্ষিণের আহ্বায়ক মো. আব্দুস সালাম ও ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব লিটন মাহমুদ।

পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র দল ও জোটগুলোও নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার মহাসমাবেশের প্রস্তুতি সভা করেছে ১২ দলীয় জোট। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের সভাপতিত্বে উক্ত সভায় বক্তব্য দেন কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, জমিয়তের মুফতি গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের (বিএমএল) শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, বাংলাদেশ লেবার পার্টির ফারুক রহমান, জাতীয় পার্টির আহসান হাবিব লিংকন প্রমুখ।

রাজশাহীতে বাস-ট্রেনে বাড়তি চাপ নেই

রাজশাহী ব্যুরো জানায়, ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে রাজশাহী থেকে ঢাকায় যাওয়া নিয়ে যানবাহনে বাড়তি কোনো চাপ নেই। তবে ট্রেনের টিকিট শেষ হয়ে গেছে। মহাসমাবেশ ঘিরে দূর পাল্লার যানবাহন বন্ধেরও কোনো পরিকল্পনা কিংবা আশঙ্কা নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন ও দূরপাল্লার বিভিন্ন বাস টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী ২৬ ও ২৭ তারিখে ট্রেনের কোনো টিকিট নেই। তবে এটিকে নিয়মিত ও স্বাভাবিক বিষয় বলছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা।

বিভিন্ন বাস কাউন্টার ঘুরে দেখা গেছে, ২৬ ও ২৭ অক্টোবরের টিকিটের কোনো সংকট নেই। অধিকাংশ সার্ভিসের ওই দুদিনের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘ঢাকার মহাসমাবেশে রাজশাহীর যেসব নেতাকর্মী যোগদান করবেন, তাদের চার ভাগের এক ভাগ এখন ঢাকায় অবস্থান করছে। বুধবারের মধ্যে অধিকাংশ নেতাকর্মী বাস ও ট্রেনে ঢাকায় পৌঁছে যাবেন। রাজশাহীতে যাদের জরুরি কাজ রয়েছে শুধু তারাই ২৭ তারিখে ঢাকায় যাবেন।’

রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সহসভাপতি মো. নুরুজ্জামান মোহন বলেন, ‘বিএনপির সমাবেশ ঘিরে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। স্বাভাবিকভাবে দূরপাল্লার বাস চলবে। ২৮ অক্টোবর ঘিরে দূরপাল্লার বাস বন্ধের কোনো নির্দেশনা নেই।’