শাকিল রহমান ১৮ জানুয়ারি ২০২৫ , ৮:৩৪ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
একটি ছোট্ট ছেলে, বয়স মাত্র সাড়ে পাঁচ। বাবা-মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়ার কথা, খেলাধুলায় মেতে ওঠার কথা। কিন্তু ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তার জীবন বদলে যায় চিরতরে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে নির্মমভাবে খুন করা হয় তাদের নিজ বাসায়। আর সেই ছোট্ট ছেলেটি—মাহির সারোয়ার মেঘ—হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বাস্তবতার কঠিন আঘাতের দিকে।
আজ এক যুগ পেরিয়ে গেছে। মেঘ বড় হয়েছে, ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তার বাবা-মায়ের খুনিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। ১১২ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ। বিচার প্রক্রিয়া যেন এক অন্তহীন অপেক্ষার নাম।
মেঘ এখন একজন উদীয়মান ক্রিকেটার। সম্প্রতি বিসিবির ইয়ুথ টাইগার অনূর্ধ্ব-১৬ জোনাল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে পঞ্চগড় দলের হয়ে খেলতে গিয়েছিলেন। তবে বাবা-মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর কারণে সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরেছেন।
সাগর-রুনি কি চেয়েছিলেন তাদের একমাত্র সন্তান ক্রিকেটার হোক? মেঘের জানা নেই। সে বলল, “আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের কী স্বপ্ন ছিল, তা জানি না। তখন আমি ক্রিকেট খেলাই শুরু করিনি। এখন লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রিকেটেও মনোযোগ দিচ্ছি। আমার স্বপ্ন, একদিন জাতীয় দলে খেলব।”
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি পেস বোলিংও করেন মেঘ। তবে বল হাতে ঝড় তুলতে বেশি ভালো লাগে তার। আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল, “আমি যদি এক বছর নিয়মিত অনুশীলন করতে পারি, তাহলে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে জায়গা পাব। এরপর একদিন জাতীয় দলেও খেলব, ইনশাল্লাহ।”
সাকিব, মাশরাফি আর মোস্তাফিজের মতো হতে চায় মেঘ।
মেঘের ক্রিকেটের নায়ক সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মর্তুজা আর মোস্তাফিজুর রহমান। ছোটবেলা থেকেই সাকিবের ভক্ত। ২০১২ সালে সাগর-রুনির স্মরণে আয়োজিত এক প্রদর্শনীতে সাকিব ও তার স্ত্রী শিশির এসেছিলেন মেঘের সঙ্গে দেখা করতে।
সাকিবকে নিয়ে বলতে গিয়ে মেঘের চোখে-মুখে স্বপ্নের ঝলক দেখা গেল। বলল, “আমি সাকিবের মতো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হতে চাই। তার মতো দেশের জন্য খেলতে চাই, সম্মান বয়ে আনতে চাই। আমি সবসময় তার খেলা অনুসরণ করি।”
শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের একাডেমিতে ক্রিকেট শিখছে মেঘ। মামা নওশের রোমান তার অভিভাবকের ভূমিকা পালন করছেন। বললেন, “ক্রিকেট নিয়ে মেঘের প্রচণ্ড আগ্রহ। কঠোর পরিশ্রম করছে, লেখাপড়ার বাইরেও ক্রিকেট ছাড়া কিছুই ভাবে না।”
এক যুগে ১১২ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর থেকে শুরু হয়েছে এক অন্তহীন বিচারপ্রক্রিয়া। প্রথমে তদন্তের দায়িত্বে ছিল শেরেবাংলা নগর থানা, পরে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কিন্তু ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর র্যাবের হাতে আসে তদন্তের ভার।
২০১৫ সালে র্যাব জানায়, সাগর-রুনির বাসা থেকে সংগ্রহ করা আলামতে দুই অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হলেও, অপরাধীদের শনাক্ত করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য মেলেনি।
এখন পর্যন্ত এ মামলায় আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ছয়জন কারাগারে, দুজন জামিনে মুক্ত। কিন্তু মূল হোতারা রয়ে গেছে অন্ধকারের আড়ালে।
দীর্ঘ বিচারহীনতার কারণে সাংবাদিক সমাজে ক্ষোভ ক্রমেই বেড়েছে। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট তদন্তে গতি আনতে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রসচিবকে বলা হয়েছে ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে।
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, “৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের ধরা হবে।” সেই ৪৮ ঘণ্টা আজ এক যুগে রূপ নিয়েছে। বিচার এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
আর এই পুরো সময়টায় মেঘ শুধু বেড়ে উঠেছে বাবা-মা ছাড়া। স্বপ্ন দেখেছে ক্রিকেটার হওয়ার। হয়তো একদিন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপাবেন তিনি। কিন্তু তার বাবা-মা গ্যালারিতে বসে দেখবেন না সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
তবে মেঘের বিশ্বাস, ওপার থেকে তার বাবা-মা ঠিকই দেখবেন। “আমি যদি জাতীয় দলে সুযোগ পাই, বাবা-মা ওপার থেকেও খুশি হবেন। আমি তাদের খুশির জন্যই ক্রিকেট খেলতে চাই,” বলল মেঘ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি পারবে সাগরের হত্যাকারীদের বিচার করতে ? নাকি আগামী বছরও একই খবরের পুনরাবৃত্তি হবে—’সাগর-রুনি হত্যা মামলা: তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ আবার পেছাল’?
শাকিল রহমান,
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।