এস এম রাফি ২০ অক্টোবর ২০২৩ , ৫:৩১ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
গাইবান্ধা প্রতিনিধি: স্ক্যাভেঞ্জিং পোল্ট্রির পরিবেশ বান্ধব শেড (ঘর) হওয়ার কথা ছিলো চৌচালা। করা হয়েছে সেখানে দো’চালা। চালে দেয়ার কথা ছিলো মেরুন রঙ্গের ০.৪৫৭ মিমি গেজ পুরুত্ত্ব ইন্ডাস্ট্রিয়াল টিন। দেয়া হয়েছে সেখানে ০.২৬০ মিমি গেজ। টিনের তাপ নিয়ন্ত্রণে চালে ব্যবহার করা হয়নি ইনসুলেটর। বেড়ায় কেবলমাত্র প্লাস্টিকের জালি দেয়া হয়েছে। অথচ সেখানে দেয়ার কথা ছিলো প্লাস্টিকে মোড়ানো ১৪ নম্বর গেজ জিআই তারের জালি। ১০ মিমি সাইজের রডের তৈরি দরজা দেয়ার ছিলো। কিন্তু সেখানে দেয়া হয়েছে কাঠের দরজা। ১ ফুট উচ্চতার ১০ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনির ৯ টি পিলার থাকার কথা থাকলেও ৭ টি পিলার করা হয়েছে।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার স্ক্যাভেঞ্জিং পোল্ট্রির পরিবেশবান্ধব শেড নির্মাণে এ অনিয়মগুলো পাওয়া গেছে। খড়ি হিসেবে বিক্রি হবে এমন সব কাঠ দিয়ে শেডের বাটাম বানানো হয়। এছাড়াও ব্যবহৃত কাঠের ধরণ ও সাইজসহ নির্মাণ কাজের পরদে পরদে অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) কর্তৃক গঠিত প্রডিউসার গ্রুপের (পিজি) সদস্যদের জন্য ইনভেস্টমেন্ট সাপোর্টের আওতায় মুরগির পরিবেশবান্ধব শেড (ঘর) নির্মাণের জন্য এ বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পের অর্থ দিয়ে ঘর নির্মাণের লক্ষ্যে পিজি সদস্যদের সঙ্গে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিনামা সম্পাদন ও ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর নেন ওই প্রকল্পের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
প্রতিটি শেড নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ২০ হাজার করে টাকা। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৫ ইউনিয়নে মোট ১৪৬ জনকে দেওয়া হয় সর্বমোট ২৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। অ্যাকাউন্ট-পে এই চেকের টাকা উপকারভোগীরা ছাড়া টাকা উত্তোলন সম্ভব না। আর শেড নির্মাণের কাজ উপকারভোগীদের সম্পাদন করার কথা থাকলেও প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তারা উপকারভোগীদের ছাড়াই এ টাকা উত্তোলন করে নিজেদের ইচ্ছামতো শেড নির্মাণের কাজ করেছেন।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর জানায়, উপজেলার তারাপুর, বেলকা ও সর্বানন্দ ইউনিয়নে ৩০ টি করে এবং হরিপুর ও কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়নে ২৮ টি করে মোট ১৪৬ টি পরিবেশবান্ধব মুরগীর শেড নির্মাণের বরাদ্দ আসে। যা উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল বাস্তবায়ন করেছে।
গত কয়েকদিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে এ ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। এতে করে ক্ষোভ জানিয়েছেন পিজির সদস্যগণ। তারা বলছেন, কাজ আমাদের করার কথা ছিলো। প্রকল্পের ডিজাইন অনুযায়ী অফিসের কর্তারা শেড তৈরি করে দেবেন এমন প্রতিশ্রুতিতে তারা কাজটি আমাদের করতে দেয়নি। তারা নিম্নমানের ইট, পরিমাণে কম বালু ও সিমেন্ট দিয়ে নির্মাণ কাজ শেষ করেছেন। আমরা নিজেরা কাজ করলে এতো নরমাল হতো না। অফিসের লোকজন করায় আজ এ অবস্থা। আর সে কারণে মুরগী রাখতেও ভয় পাচ্ছি আমরা।
সর্বানন্দ ইউনিয়নের তালুক বাজিত গ্রামের পিজি সদস্য মোছা. মৌসুমি আক্তার বলেন, ‘আমাদেরকে বলেছে যে, তোমাদের বিশ হাজার টাকা বাজেট আইচছে। এই হিসেবে আমরা স্বাক্ষর করেছি। আমাদের ঘরও উঠাই দিছে উনারা। বলছে বিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ টুকুই আমরা জানি। এখন যে কতো খরচ হলো তা জানিনা। তবে এ ঘর নির্মাণে বিশ হাজার টাকা খরচ হয়নি স্বীকার করে বলেন এখানে মুরগী রাখা নিরাপদ নয়। সে কারণে রাতে রাখি না।’
মৌসুমির স্বামী মো. মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘শুনেছি বিশ হাজার টাকা বাজেট। তো এখানে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে আমার ধারণা। এখানে চড়াই রাখার কোনো পরিবেশ নেই। কারণ হাত দিয়ে টান দিলেই এগুলো খুলে আসে।’
একই গ্রামের পিজি সদস্য মোছা. জুই আক্তার বলেন, ‘কাজ উমরায় কইরছে। হামাক খালি ৫০ টা ইট আইনতে বলছে। ওমার বাড়ি থাকি আনি দিছি। মিস্ত্রি কাজ করেছে। আর আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র উমরায় আনিয়া উমরায় কাজ করি গেইছে। টাকা পয়সা হামার হাতোত দেয় নাই।’
তারাপুর ইউনিয়নের নিজাম খাঁ গ্রামের পিজি সদস্য মোছা. দুলালী বেগম বলেন, ‘বরাদ্দ বিশ হাজার টাকা দিলো। ঘরটা আমাদের করার কথা ছিলো। কিন্তু অফিস থাকি কাজ কইরছে। এ ঘরে মুরগী রাখার পর গাড়োয়া ঠ্যাং টানি নিয়া যায়। সেই কারণে জাল দিয়েছি। বৃষ্টিতে ভেজে সে কারণে পলিথিন দিয়ে দিতে হয়।’
এ বিষয়ে কথা হয় মাঠ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বিপ্লব দেবের সাথে। তিনি হরিপুর ইউনিয়নের এলএসপি। তিনি বলেন, ‘অফিস থেকে আমাদেরকে কাজের কোনো সিডিউল দেয়া হয়নি। পাশ্ববর্তী সাদুল্লাপুর উপজেলার ঘরগুলো দেখে আমি কাজ করেছি।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ইউএলও) মো. ফজলুল করিম বলেন, মুরগীর শেডগুলো সিডিউল মোতাবেক করা হয়েছে। এতে কোনো ধরনের অনিয়ম করা হয়নি। আপনাদের সন্দেহ হলে জুডিশিয়ালি মাঠে গিয়ে দেখতে পারেন।
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
গাইবান্ধা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাক্তার মো. মাহফুজার রহমান বলেন, সিডিউলের বাহিরে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। অবশ্যই সিডিউল মোতাবেক কাজ করতে হবে। আমি দ্রুত মুরগীর শেডগুলো পরিদর্শন করবো। অনিয়ম প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।