এস এম রাফি ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ১:১১ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃঅনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতা পিছু ছাড়ছে না কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুনের। টেন্ডার ড্রপে বঁাধা, টাস্কফোর্স দ্বারা বাতিলকৃত জিও ব্যাগ ডাম্পিং, ক্ষতিপূরণ না দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের ভিটা, ভুট্টা ও আলু ক্ষেত ভেকু দিয়ে কেটে ঢালুকরণ, ঠিকাদারের কাজ নিজে করাসহ নানা অনিয়েমের ফের অভিযোগ ওঠেছে তার বিরুদ্ধে। এনিয়ে ভাঙ্গনকবলীত এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
খেঁাজ নিয়ে জানা যায়, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রাধীন গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জের কারেন্ট বাজার এলাকার নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে সাড়ে ছয় কোটি টাকা জরুরি বরাদ্দ দেয় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। কাজটি নিজের করে রাখতে শুরু থেকেই কারসাজির আশ্রয় নেয় কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী। ই-জিপি হলেও কাজটি পেতে যোগাযোগকারী ঠিকাদারদের টেন্ডার ড্রপ করতে নিরুৎসাহিত করেন তিনি। পছন্দের ঠিকাদার ঠিকাদার হাসিবুল হাসানকে পাইয়ে দিয়ে কাজটি নিজেই করছেন নির্বাহী প্রকৌশলী। মুল ঠিকাদার না থাকায় কাজে ভাগ বসিয়েছেন গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের এমপি শামীম হায়দার পাটোয়ারী। এখন ১ কিলোমিটার কাজের ৫শ মিটার এমপি ও বাকী অর্ধেক কাজ করছেন কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড।
প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে- সঠিক সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় যে এলাকা রক্ষার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা ভেঙ্গে গেছে। লোকালয় ছেড়ে এখন চরের কিছু জমি রক্ষায় কাজ হচ্ছে। সেখানেও অনিয়মের অভিযোগ স্থানীয়দের।
গত ১৪ জানুয়ারি কারেন্ট বাজার এলাকায় বস্তা গণনা করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের টাস্কফোর্স কমিটির দুই জন সদস্য। এসময় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) মোঃ মাহবুবর রহমান, কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ সহকারী প্রকৌশলী ও কাজটির মাঠ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও স্থানীয় কয়েকশ মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
জিও ব্যাগ গণনার আগে কাজের মান ও স্থানীয়দের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পুর) মোঃ মাহবুবর রহমান স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, জিও ব্যাগ ও বালুর মান ঠিক আছে। কাজ নিয়ে আমি সন্তুষ্ট।
উপস্থিত স্থানীয়রা জানান, তার এই বক্তব্যের পরই গণনার কাজ শুরু হয়। এতে একের পর এক কাঁদা-বালু মিশ্রিত বস্তা, ছেড়া বস্তা ও নিম্ন মানের বস্তা বের হতে থাকে। টাস্কফোর্স সদস্যদের দেখিয়ে দিয়ে আমরা প্রায় ১৫শ বস্তা রিজেক্ট করাতে বাধ্য করি। সঠিক মান ধরে হিসাব করলে ৫শ বস্তাও ভালো বের হবে না। যেসব উধ্বর্তস কর্তৃপক্ষ উপস্থিত ছিলেন, তাদের উচিত ছিল কাজটি অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু তা না করে, অনিয়মকারীদের উস্কে দেয়া হয়েছে। বস্তা গণনার সময় রিজেক্ট বস্তা গণনায় ধরতে উপ সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম টাস্কফোর্স সদ্যদের বাধ্য করেন।
জিও ব্যাগ গণনার পরে বিষয়টি নিয়ে মোঃ মাহবুবর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খারাপ বস্তা পাওয়ার খবরটি জানা নেই। তবে কিছু বস্তা খারাপ থাকতেই পারে।
বালুর বস্তা গণনার কাজের পুরো সময় উপস্থিত থাকা স্থানীয় বাসিন্দা দুলাল মিয়া বলেন, এখানে দুটি গ্রুপে কাজ হচ্ছে। অফিসের গ্রুপ আর এমপির গ্রুপ। কোন ঠিকাদার এখানে কাজ করছেন না। অফিসের গ্রুপের কাজে স্থানীয়রা ধরে ধরে যেসব বস্তা দেখিয়ে দিয়েছি তার কিছু বস্তা রিজেক্ট করা হয়েছে। এর পরিমাণ ১৫শ’র মত। মোট গণনা করেছে রিজেক্ট বস্তাসহ ১১হাজার ৫শ। এখন তারা যদি ১১হাজার ৫শ বস্তা কাউন্ট দেখিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই রিজেক্ট বস্তাও হিসাবের তালিকায় দেখানো হয়েছে। এমপির গ্রুপে গণনা করা হয়েছে ৭হাজার ৪২৬। এখানে রিজেক্ট বস্তার পরিমাণ কম।
খেঁাজ নিয়ে জানা যায়, সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারি স্থানীয়দের অগোচরে ২য় দফায় বস্তা গণনা করা হয়েছে। মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে সাড়ে দশ হাজার বস্তা গুণলেও একই বালু ও বস্তা ব্যবহার করলেও কোন রিজেক্ট জিও ব্যাগ দেখায়নি গণনাকারীরা। এরই মধ্যে অনিয়মের এই কাজের বিল দাখিল করা হয়েছে বলে অফিস সূত্রে জানা গেছে।
নানা অনিয়ম আর দুনর্ীতির কারণে গত বছরের আগষ্টে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো), কুড়িগ্রাম বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পে চারটি অডিট আপত্তি আসে। কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন ঠেকাতে চিলমারী ও উলিপুর উপজেলায় ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষা অনুযায়ী এসেছে এসব অডিট আপত্তি। এতে মোট অর্থের পরিমাণ ১৯ কোটি ১ লাখ ৩১ হাজার ৪৪৩ টাকা। সে সময় ব্যাপক সমালোচিত হন কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডে কাজ করা কয়েকজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানায় যায়, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সখ্যতা নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুনের। এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছেন তিনি। সঠিকভাবে টেন্ডার ড্রপ করেও শুধু লেনদেনের সম্পর্ক না থাকায় কাজ পায়নি তারা। এমন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বদলিসহ বিভাগীয় শাস্তি চান ভুক্তভোগী এসব ঠিকাদার।
এ বিষয়ে মেসার্স সিদ্দিক স্প্লায়ার্স এর মালিক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, কারেন্ট বাজারের সাড়ে ছয় কোটি টাকার কাজটি করতে টেন্ডার ফেলতে চেয়েছিলাম। এজন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন সাহেবের কাছে যাই। তিনি টেন্ডার ফেলতে নিষেধ করায় ফিরে এসেছি। আমি সেদিনই তার কথা-বার্তায় বুঝতে পেরেছি, কাজটি তিনি নিজে করবেন। তিনি আমাকে খাল খননের আরেকটি কাজে ডেন্ডার ড্রপ করতে বলেছিলেন। টেন্ডার ফেলেও ছিলাম। কিন্তু তার একের পর এক টেন্ডার বহিঃর্ভুত শর্তের কারণে তা প্রত্যাহার করি। এতে আমাকে ব্যাংক পে অর্ডারে ১লাখ ২৩ হাজার টাকা ভতর্থকি দিতে হয়েছে।
ভিটা ও আবাদী জমি ঢালু করে বস্তা ফেলার অভিযোগ করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, আমরা বার বার অনুরোধ করেছি যাতে আমাদের শেষ সম্ভব ভিটা ও আলুর ক্ষেত ঢালু না করা হয়। প্রয়োজনে যেন নদী গভীর করে সেখানে বস্তা ফেলা হয় তা কতৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়েছি কিন্তু তারা কোন কথা শোনেনি। উপ-বিভাগী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও উপ প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম জোর করে আমাদের জমি কেটে নষ্ট করছেন। বলতে গেলেও তারা আমাদের হুমকিও দিয়েছেন। আমাদের কোন ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়নি।
রিজেক্ট বস্তা ডাম্পিংএর কথা স্বীকার করে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বস্তাগুলো ফেলে না দিয়ে আমরা ডাম্পিং এর নির্দেশ দিয়েছি। এগুলো কাউন্ট (হিসাব) করা হয়নি।
তিনি আরো বলেন, আবাদী জমির স্লোপিং (ঢালুকরণে) কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। এমন কোন নিয়ম নেই। সঠিক নিয়মেই টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বাতিল কৃত বস্তা ফেলানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে জানিয়ে করে উপ সহকারী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদারে এটা জরিমানা, আর সেগুলো তো গণনার বাহিরে, ফেললে বরং উপকার। রিজেক্ট বস্তা হিসাবের তালিকায় উল্লেখ করার কথা অস্বীকার করেন তিনি।
কুড়িগ্রাম ডিসি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, অনিয়মের বিষয়টি জানাজানি হলেও প্রকল্প এলাকায় খেঁাজ নেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক। পরে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ডেকে সতর্ক করে এবং কাজ সঠিকভাবে করাতে নির্দেশ দেন তিনি।