বিবিধ

প্রাথমিক শিক্ষার দিশা-বিদিশা

  Editor ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ , ২:২৫ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ

নাহিদ হাসান

১.সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে একজন শিশুর ১১ বছরের স্কুলজীবনের সাড়ে চার বছর নষ্ট হয়ে যায়। তারা ১১ বছরে শেখে মাত্র সাড়ে ছয় বছরের পাঠ্যক্রমের সমান। পঞ্চম শ্রেণির প্রতি চারজন শিক্ষার্থীর তিনজনই নিজেদের শ্রেণির সাধারণ মানের অঙ্ক কষতে পারে না। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশই ভালোভাবে বাংলা পড়তে পারে না।
তাদের ৪৩ শতাংশ বাংলায় কোনো প্রশ্নের পুরো উত্তর দিতে পারে না। এই দুর্বলতার পেছনে চারটি বড় কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। সেগুলো হলোÑ শৈশব জীবনের মানোন্নয়ন কর্মসূচিগুলোর দুর্বলতা, নিম্নমানের পাঠদান, দুর্বল স্কুলব্যবস্থাপনা ও শিক্ষা খাতে সরকারি কম বিনিয়োগ।

যে দেশের শিশুরা বইয়ের ভারে নতজানু, তাদের শৈশবের মানোন্নয়ন কীভাবে হবে? শহরের শিশুরা নদী-গাছ-ধান-প্রকৃতিকে জানে না, তেমনিভাবে গ্রামের-চরের শিশুরা প্রত্যেকে সাঁতার থেকে শুরু করে মাছ ধরা, নৌকা চালানো, মেঘ-ঝড়-বৃষ্টিকে জানলেও তাদের এই জানাকে অযোগ্যতা হিসেবেই দেখা হয়।
বলা হয়, নেদারল্যান্ডসের শিশুরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী। কেন সুখী? কারণ সেখানকার শিক্ষকরা বই পড়েন আর শিশুরা ইচ্ছে হলে পড়ে, না হলে নাই। শিশুরা নামতা পড়ার জন্য ডিপ্লোমা পায়, সাঁতারের জন্য, সাইকেল চালানোর জন্য, নৌকা চালানোর জন্য, গাছ চেনার জন্য, ফুল-পাখি-উৎসব-ঘর সাজানো সবকিছুর জন্য ডিপ্লোমা পায়। এক বছর বয়স থেকেই স্কুলে গান, চারুকারু ও খেলাধুলার জন্য শিক্ষক পায়। আর আমরা বিদ্যালয়কে খাঁচা বানিয়ে ফেলেছি।
আমরা যারা খাঁচায় বেড়ে ওঠা পাখি, তারা বনের পাখিকে খাঁচায় ডাকছি। আজও পর্যন্ত প্রাথমিক স্কুলগুলোতে গানের, চারুকারুর ও খেলাধুলার শিক্ষক আমরা দিতে পারিনি।

দেখা যাচ্ছে, স্কুলে বিস্কুট দেওয়ার পরও শিশুরা বাড়ি থেকে টিফিন আনছে, কারণ বিস্কুট খেয়ে তো পেট ভরে না। একই খাদ্য বারবার খেলে তো অরুচিও চলে আসে। এমনটা হতে পারতÑ প্রত্যেকটা ঋতুতে যে সবজি পাওয়া যায়, তার গুণাগুণ নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করা গেল, তারপর সবাই মিলে রান্না করা গেল, তারপর সবাই মিলে খাওয়া গেল। বাচ্চারা সাধারণত সবজি খেতে চায় না, এতে সবজির প্রতি তাদের আগ্রহও বাড়বে, সুষম খাদ্য সম্পর্কে তাদের জ্ঞানার্জনও হাতেনাতে তারা শিখল। এটা ছাড়া প্রতিটি স্কুলের পাশে গাভি ও মোষের খামার করে দুধের চাহিদাও মেটানো যায়। এতে বিস্কুট বাবদ খরচও সাশ্রয় হবে। স্কুলে যে পিয়ন আছে সেই খামারি দেখভাল করবে আর যে বাছুর জন্মাবে বছর বছর তা বিক্রি করে সারা বছরের গো-খাদ্য কেনা যায়। এভাবে স্বাবলম্বী পরিস্থিতি তৈরি হবে।
পাঠটীকা বিন্যাস করা যায় বিভিন্ন থিমের ওপর। একটি সপ্তাহ নামতার ওপর, একটি গাছের, একটি সপ্তাহ ফুলের ওপর, প্রতিটি ঋতু ও উৎসবের ওপর, এ রকম ধরে ধরে ৫২ সপ্তাহে তারা হাতেনাতে সব শিখবে। আমরা দেখব আমাদের স্কুলপড়–য়ারা উৎসব পালনের রীতিগুলো জানে না, যে যত ভালো ছাত্র সে তত অজ্ঞ এসব ব্যাপারে। কিন্তু আমাদের দাদা-নানারা, দাদি-নানিরা যখন শিশু ছিলেন, তারা এসব শিখেছেন হাতেনাতে, শিখেছেন জীবনের অংশ হিসেবে। তারা জানতেন কোন গাছের কী ঔষধি গুণ, ফলে তারা গাছপালাকে, প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে রক্ষায় ভূমিকা রাখতেন। উৎসবগুলো টিকে আছে আমাদের কথিত অশিক্ষিত জনগণের জন্যই। আর আমরা শিক্ষিত হওয়ার যে প্রণালিতে প্রবেশ করছি, তাতে আমরা এই ভূগোলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছি। আমরা ধানের গুণাগুণ জানি না বলেই সারা বছর একই জাতের ধানের ভাত খাই আর কোম্পানির ওষুধ রাজনীতির চক্রে আটকা পড়ি। তাই এখনো দেখা যায়, সেনাবাহিনী-নৌবাহিনীতে সৈনিক পদে গ্রামের ছেলেরাই চান্স পায়।

উন্নত শিক্ষাব্যবস্থায় সামাজিক উন্নয়ন, মানসিক উন্নয়ন ও পড়াশোনা নামে তিনটি ভাগ থাকে। সামাজিক উন্নয়ন ভাগে থাকে বন্ধুর প্রতি আচরণ, ক্লাসের অন্যদের সাহায্য, স্কুলের অন্যদের প্রতি ব্যবহার ইত্যাদি। মানসিক উন্নয়ন বিভাগে দেখা হয় বাচ্চার বয়স অনুযায়ী তার ভালো লাগা, মন্দ লাগা হচ্ছে কি না, তার হাসি-কান্না, রাগ বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওঠানামা করছে কি না। আমাদের পাঠ্যক্রমে এই দুই বস্তু যে নেই, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না, পড়াশোনার ভাগেও তাই লবডঙ্কা। দেখা যাবে গ্রামের, চরের বাচ্চাদেরই কিছুটা সামাজিক ও মানসিক উন্নতি আছে প্রকৃতিগতভাবে, মানে যারা স্কুলে যায় না সেভাবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের শক্তির জায়গাগুলোকে দুর্বলতা আর যোগ্যতাকে অযোগ্যতা হিসেবে তুলে ধরে। ফলে নদীর দেশের তরুণরা বিশ্বসেরা সাঁতারু হয় না, সাঁওতাল-মুণ্ডা-ওঁরাওদের সন্তানরা তিরন্দাজ হিসেবে অংশ নিতে পারে না অলিম্পিকে। যে মারমা-মাণ্ডি-কৃষ্ণারা মাঠ কাঁপায়, তা কেবল ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফল।
২.
রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণির প্রতি চারজনের তিনজনই সাধারণ মানের অঙ্ক কষতে পারে নাÑ বিশ্বব্যাংকের এই রিপোর্টটির প্রতিবাদে বলা যায়, উনিশ শতকের প্রথম দিকে হোরেস হেম্যান উইলসন নামের একজন ব্রিটিশ হাউস অব লর্ডসে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, বাঙালিরা মাথা দিয়ে অঙ্ক কষেন। এ জন্য দেখা যাবে, একজন শিক্ষার্থী খাতা-কলমে অঙ্ক কষতে না পারলেও মুখে মুখে ঠিকই উত্তরটি দিতে পারে।

আর রিপোর্টটিকে সত্য ধরলে প্রশ্ন উঠবে, কেন এই দশা? নৌবিদ্যা, অঙ্ক আর জ্যোতির্বিদ্যা আমাদের অক্ষরজ্ঞানহীন নাবিকদের কাছে শেখার জন্য আঠারো শতকেও ইউরোপীয়রা আসত। সেই দেশের জনগণের লৌকিক জ্ঞান শেখার জন্য ভাষা শিখল, ছাপাখানা বসাল আর জ্ঞান বহন করে নিয়ে গেল ইউরোপে, সেই আমরা লৌকিক জ্ঞান ভুলে গেলাম? গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের সব উদ্ভিদের পেটেন্ট করে ফেলেছে শীতপ্রধান পশ্চিম। বিশ্বব্যাংক যে বলেছে তৃতীয় শ্রেণির ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না, কেন পারে না? দেখা যাবে, যে বাংলা তারা পড়ে, তা তাদের ব্যবহারিক বাংলা নয়। এই বাংলা বিদেশি ভাষার মতো। উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যানরা যে দেশীয় ভাষায় বই ছেপেছিলেন, তারা ছিলেন ইংল্যান্ডের উপযোগবাদী ব্যাপ্টিস্ট। আমরা কীভাবে ভুলে গেলাম তার নিদর্শন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।