Editor ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ , ৪:২৬ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ
জহির রায়হান , কাউনিয়া (রংপুর) থেকেঃ
জন্ম থেকে অভাব ওদের নিত্য সঙ্গী । নানা প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে জীবন যুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন ওদের চোখে মুখে। ওরা যেন আঁধার ঘরে চাঁদের আলো। এদের কারো বাবা রিকশা চালক,কেউ সাইকেল মেকার,কেউ দরিদ্র কৃষক, কারো বাবা থেকেও নেই কেউ মটর শ্রমিক। তাদের সন্তানরা এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও উচ্চ শিক্ষা কিভাবে গ্রহন করবে,অর্থের যোগান হবে কী ভাবে, সে চিন্তা ওদের সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারছেনা তারা। সমাজের বিত্তবানদের একটু সহানুভুতি পেলে কাউনিয়ার ৫ অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের আলোকিত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন পূরন হবে।
রানা মিয়াঃ এক বেলা পেটে ভাত জোটেতো আরেক বেলা নাই। শখের বসে শৌখিন কাপড় জুটতো না ভাগ্যে। দরিদ্রতা আর নানা প্রতিকুলতার সাথে যুদ্ধ করে কাউনিয়ার উদয় নারায়ন মাছহাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে রানা মিয়া । সে জে এসসি পরীক্ষাতেও জিপিএ ৫ পেয়েছিল । উপজেলার উদয় নারায়ণ মাছহাড়ী গ্রামের রিকশা চালক মোঃ খয়বার রহমান ও গৃহিনী মোছাঃ আনোয়ারা বেগমের পুত্র সে। ওরা ২ ভাই । ৬ শতক জমির বাড়ি ভিটা ছাড়া আর কোন জমি- জমা নেই তাদের। রিকশা চালক বাবার সামান্য টাকায় চলে সংসার, সে ও তার ভাইয়ের পড়া লেখার খরচ যোগাতে বিভিন্ন বাড়িতে প্রাইভেট পড়িয়েছে সে । ছেলের অনেক স্বপ্ন লেখাপড়া শিখে বিসিএস করে পুলিশের বড় কর্মকর্তা হবে, কিন্তু সেই স্বপ্নের অর্থের যোগান হবে কি ভাবে ? আর্থিক সহযোগিতা না পেলে রানা মিয়ার শিক্ষার প্রদীপও নিভে যেতে পারে। তার স্বপ্ন পূরনে এখন বড় বাঁধা দারিদ্রতা। এ বাঁধা ডিঙ্গিয়ে সেই স্বপ্ন পূরন হবে কিনা সে চিন্তাই এখন সারাক্ষন রানা মিয়া কে তাড়া করে বেড়ায় । সমাজের বৃত্তবানরাই পারে তার স্বপ্ন পুরন করতে।
আরিফা খাতুনঃ কাউনিয়া উপজেলার নাজিরদহ একতা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে অংশ নিয়ে জিপি এ-৫ পেয়েছে আরিফা খাতুন। উপজেলার কিশামত চিনাতুলী গ্রামের দরিদ্র কৃষক আশরাফুল হোসেন ও গৃহিনী ফরিদা খাতুনের এর কন্যা সে। চরম অর্থ সংকটের মাঝেও এবার এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। দরিদ্রতার সাথে লড়াই করে এসএসসি পাস করলেও উচ্চ শিক্ষা গ্রহন নিয়ে এখন দুচিন্তায় পড়েছে আরিফা। তার শিক্ষার খরচ জুটবে কিভাবে এচিন্তায় বিভোর তার দরিদ্র কৃষক পিতা । তারা ৩ ভাই বোন। আরিফা এতো দিন পড়াশুনার খরচ চালিয়েছে বিভিন্ন কারুকাজ খচিত টুপি সেলাই করে । মাত্র ১৬ শতাংশ জমিতে বাড়ি ভিটা তাদের। অন্যর জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে তার পিতা আশরাফুল। সামনে এগিয়ে যাওয়ার নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে সে। মা ফরিদা খাতুন মেয়ের সাফল্যে খুশি হলেও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। মেয়ে চায় ডাক্তার হতে, কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে কিভাবে তা সম্ভব। সংসারে একজন মাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল তাদের সংসার। তিনি মেয়ের জন্য সকলের কাছে দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।
মশিউর রহমানঃ দারিদ্রতা ও অর্থ সংকট দমিয়ে রাখতে পারেনি কাউনিয়া উপজেলার রাজীব গ্রামের মটর শ্রমিক মোঃ উজ্জ্বল মিয়ার পুত্র মশিউর রহমান কে। চরম অর্থ সংকটেও মশিউর রহমান এবার এসএসসি পরীক্ষায় কাউনিয়ার টেপামধুপুর বিএল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে এসএসসি পাস করলেও উচ্চ শিক্ষা গ্রহন নিয়ে এখন দুঃচিন্তায় পড়েছে মশিউর রহমান । মা মলিদা বেগম জানায় বাড়ী ভিটা ছাড়া কোন জমি জিরাত নেই তাদের। ওরা ২ ভাই পড়ালেখা করে। অভাবের মাঝেও সব প্রতিবন্ধকতাকে পদদলিত করে ভালো কলেজে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মশিউর রহমান । ছেলের সাফল্যে খুশি হলেও মটর শ্রমিক পিতা উজ্জ্বল তার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন। মশিউর রহমান চায় ইঞ্জিনিয়ার হতে, কিন্তু দরিদ্র পিতা- মাতার পক্ষে কিভাবে তা সম্ভব। তিনি ছেলের জন্য সকলের কাছে দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করেছেন।
মরিয়ম আক্তারঃ উপজেলার শিবু চৌ রাস্তা গ্রামের সাইকেল মেকার পিতা রাশেদ মিয়ার কন্যা মরিয়ম প্রমান করছে ইচ্ছা শক্তি থাকলে সফলতা সম্ভব । মরিয়ম আক্তার রীনা বড়ুয়াহাট কেরামতিয়া ফাজিল (ডিগ্র) মাদাসা থেকে মানবিক বিভাগে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। সাড়ে ৮ শতাংশ জমিতে নিজস্ব বসতভিটা ছাড়া আর কোন জমি নেই তাদের। মরিয়ম জানায় ছোট ভাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। সাইকেল মেকার পিতার সামান্য আয় দিয়ে ৩ ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ ও ৫ জনের সংসার চলে কোন রকমে। তাই আমার উচ্চ শিক্ষার খরচ যোগান দেয়া আমার বাবার পক্ষে অসম্ভব। তাই অভাবের সংসারে অর্থ জোগান ও পড়ালেখার খরচ জোগাতে সে প্রাইভেট পড়িয়ে এ পর্যন্ত এসেছে মরিয়ম । মা আয়েশা বেগম জানায়, তার মেয়ের স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু সাইকেল মেকার পিতার পক্ষে মেয়ের স্বপ্ন পুরুণ হবে কীভাবে।
আশরাফি আক্তার অন্তরাঃ পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় থাকলে যে সাফল্যের চরম শিখরে পৌছা যায় তার প্রমান রেখেছেন উপজেলার চাঁনঘাট গ্রামের দিন মজুর আরিফুল ইসলামের কন্যা আশরাফি আক্তার । সে শহীদবাগ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ -৫ পেয়েছে। তারা ২ বোন। পিতা আরিফুল দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রথম স্ত্রী কে বাবার বাড়িতে রেখে ছোট বউ নিয়ে অনত্র্য বসবাস করছেন। আশরাফি মায়ের সাথে বল্লভ বিষু গ্রামে নানার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করছে।সে বিসিএস দিয়ে শিক্ষকহতে চায় কিন্তু টানাটানির সংসারে মেয়ের আশা পূরণ করা কী সম্ভব। বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন পূরুণ হতে পারে আশরাফির।
জহির রায়হান
কাউনিয়া (রংপুর) প্রতিনিধি
মোবাঃ
তারিখঃ ২৫/১২/২০২২ইং