সারাদেশ

‘শেখের বেটির কাছোত হামার দাবি তিস্তা নদীর বান্দোন চাই’

  এস এম রাফি ১ আগস্ট ২০২৩ , ১১:৫১ অপরাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ

অংপুরে শেখের বেটি হাসিনা আসবে। তার কাছোত হামার দাবি তিস্তা নদীর বান্দোন (বাঁধ) চাই। এই বান্দোন হইলে জমি ফিরি পামো। ঘরবাড়ি করি থাকমো। হামার (আমাদের) খুব উপকার হইবে। আগের মত সুখোত থাকমো এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন তিস্তা পাড়ের জোহরা (৪৫) ও হাজেরা বেওয়া।

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার নিজ গড্ডিমারী গ্রামের অসহায় হাজরা বেওয়া। স্বামী সোলেমান গণি গত ১০ বছর পূর্বে মারা যান। সে থেকে হাজেরা বেওয়া ছেলে সন্তান নিয়ে তিস্তার গাইড বানে আশ্রয় নিয়ে আছেন। একসময় সবে ছিল তাদের। তিস্তার করাল গ্রাসে একে একে ৬ বার ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় নিঃস্ব হয় পরিবারটি।

একই এলাকার জোহরা বেগম। স্বামী সাঈদ আলী। তিস্তায় ৫ বার বসতভিটা জায়গা জমি হারিয়ে আজ দিনমজুর। তাদের দাবি আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রংপুরে আসলে যেন তিস্তা নদীর খনন ও দুই ধারে বাঁধ নির্মাণ করে আমাদের বসতভিটা রক্ষা করে এমনটাই প্রত্যাশা তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষ।
প্রধানমন্ত্রীর আসার খবরে তিস্তায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আশায় বুক বাঁধছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কয়েকদিন আগে উজানে ঢলে তিস্তার পানি যে গতিতে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি গতি নিয়ে কমতে শুরু করছে। পানির স্রোতে আর ঢলের তোড়ে ভেঙে যাচ্ছে নদীর দুই তীরের অরক্ষিত পাড়। সারা জীবনের শ্রম আর ঘামে বানানো পাকা ঘর বাড়ি নিমিষেই বিলীন হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়নের চর সিন্দুর্না ২ নং ওয়ার্ডের জাহিদের পরিবার। বর্তমানে জাহিদের পরিবার অন্যের জমিতে টিনশেড ঘরে আশ্রয় নিয়ে আছেন।

বাকরুদ্ধ জাহিদ জানান, বাবার সামান্য একজন কৃষক। অনেক কষ্টের রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স পাশ করেও চাকরি জোটেনি। এদিকে গতবছর জায়গা জমি বাড়িঘর নদীর গর্ভে চলে যায়। নিঃস্ব হয়ে পড়ি পরিবারটি। এক আত্মীয়ের কাছে এক টুকরো জমি নিয়ে বাবা মা সহ কোনমতে বাড়ি করে আছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রাণের দাবি নদীর দুই তীরে বাঁধ নির্মাণ করা। তিস্তায় বাঁধ নির্মাণ হলে ৩০ বছরের হারিয়ে যাওয়া জায়গা জমি ফিরে পাব।

জাহিদের পরিবারের মতো অসংখ্য পরিবারের ঠিকানা এখন গাইড বাঁধে। তিস্তা সেতুর ভাটিতে গতিয়াসামের শত শত পরিবারের বাঁচার আর্তি যেন কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

জানা গেছে, তিস্তায় প্রতিবছর পানিসঙ্কটে শুষ্ক মৌসুমে কৃষি জমিতে সেচ নিয়ে বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার কৃষক। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে তিস্তার পাহাড়ি ঢলে তিস্তা ব্যারাজের গেট খুলে দেয়ায় সেখান থেকে নেমে আসা পানিতে প্রতিবছরই বন্যায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে অতিপ্রবাহের কারণে তিস্তা নদী গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। পাশাপাশি বিষয়টি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মাঝেও কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অভিন্ন নদী তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশের পর নীলফামারী, লালমনিরহাট,রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় ১২টি উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ১১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ডানতীরের ৭০ কিলোমিটার বাঁধ থাকলেও দুই তীরের ১৬০ কিলোমিটার এখনও সম্পূর্ণ অরক্ষিত।

হাতীবান্ধা উপজেলার গুড্ডিমারি ইউনিয়নের নিউ গুড্ডিমারি গ্রামের আব্দুল মান্নান বলেন,বর্তমানে তিস্তার ভাঙ্গনের কবল থেকে হেফাজতে আছি। তারপরও দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় কখন ভেঙে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি ভারত সীমান্ত থেকে চন্ডিমারী পর্যন্ত তিস্তা দুইতীরে বাধঁ ও খনন করলে তিস্তা পাড়ের লাখো মানুষ উপকৃত হবে।

তিস্তা পারের সাঈদ আলী বলেন,প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের একটাই আবদার তিস্তা নদীর বাঁধ নির্মাণ করা। তিস্তা নদীতে কয়েক এক একর জমি পড়ে আছে। বাধঁ হলে জমিগুলোর ফিরে পাবো।

হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম আরিফ বলেন,এই ইউনিয়নের ৮টি ওয়ার্ডেই নদীর গর্ভে। প্রতিবছর বন্যা ও ভাঙ্গনের সংকুচিত হচ্ছে ইউনিয়ন টি। গত ২০ বছরে প্রায় দুই হাজার পরিবার বসভিটে হারা হয়েছে। তাই আমাদের দাবি পদ্মা সেতুর মতো নিজ অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নদী তীরের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। শিল্প কলকারখানা, নদীবন্দর গড়ে ওঠবে। আমরা চাই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ দ্রুত শুরু হোক। এখন তিস্তা পাড়ের দুই কোটি মানুষ তিস্তার মহাপরিকল্পনা ঘোষণা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছেন।